শ্রেয়সী  ( February ,2025 )
                         ISSN -2581-4079

                                      শ্রেয়সী  ( February ,2025 )
                         ISSN -2581-4079

এই খানে ক্লিক করুন

প্রবন্ধ 

বৈষ্ণব কবি বসন্ত রায়: সমকালীন গৌড়ীয় সাধনার প্রেক্ষিত এবং তাঁর পদাবলীতে গৌড়ীয় রসতত্ত্বের প্রতিফলন    



                                                                                                          অনন্য দাস            

বসন্ত রায় ষোড়শ শতাব্দীর অন্যতম একজন কবি-ব্যক্তিত্ব। ‘ভক্তিরত্নাকর’, ‘নরোত্তমবিলাস’, ‘কর্ণানন্দ’ প্রভৃতি গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি ষোড়শ শতকের একজন অনবদ্য বৈষ্ণব সাধক ছিলেন। উপরন্তু তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ এবং আচার্য নরোত্তম দত্তের সুযোগ্য মন্ত্র-শিষ্যও ছিলেন। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস কবিরাজ তাঁর রচিত পদাবলীর ভনিতায় বসন্ত রায়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অষ্টাদশ শতকের গৌণজীবনী কাব্যগুলিতেও কবি বসন্ত রায়ের প্রতিভার স্বীকৃতি উজ্জ্বলরূপে তুলে ধরা হয়েছে। এই সমস্ত পরিচয় ব্যতীত গৌড়ীয় ভক্তি-প্রচারণায়ও কবি বসন্ত রায়ের স্বয়ংক্রিয় ভূমিকা ছিল। ষোড়শ শতকের ভক্তিসাধনার পরম্পরা লক্ষ করলে স্পষ্ট হবে যে, শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ প্রমুখের তিরোভাবের পর বাংলার বৈষ্ণব-গোষ্ঠী এবং পুরী ও বৃন্দাবনের বৈষ্ণব-গোষ্ঠীর সাধনার মধ্যে কোন ঐক্য ছিল না। বিশেষ করে বাংলার বৈষ্ণবগণ পৃথক পৃথক উপাসনা তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। অন্যদিকে শাস্ত্রচর্চায় ষড়গোস্বামী এবং তাদের শিষ্য-গোষ্ঠী যথেষ্টই পারঙ্গম ছিলেন। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় পাদে শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম দত্ত এবং শ্যামানন্দ প্রভু বাংলা থেকে ভক্তি-শাস্ত্র চর্চার জন্য বৃন্দাবনে যান। দীর্ঘকাল সাধনা এবং অধ্যয়ন করে গোস্বামী শাস্ত্রসমূহের সম্যক জ্ঞান বাংলায় প্রচার করেন। বৃন্দাবনের গোস্বামীদের প্রণীত গ্রন্থাদিও শ্রীনিবাস আচার্য বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন। এই ত্রয়ী বৈষ্ণব অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, নরহরি সরকার প্রমুখের উত্তরসূরীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সর্বজনীন বৈষ্ণবাদর্শ স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হন। তাদের প্রচেষ্টায় ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘খেতুরী মহোৎসব’। এই খেতুরী মহোৎসবে এই মোটামুটি একটি সর্বজনীন উপাসনার আদর্শ গৃহীত হয়েছিল। নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী ‘জাহ্নবা দেবী’ এই উৎসবের নেত্রীর আসন অলংকৃত করেন। এর অব্যবহিত পরেই বাংলার বৈষ্ণব-গোষ্ঠীর সঙ্গে বৃন্দাবনের জীব গোস্বামী, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখের পত্র আদান-প্রদান শুরু হয়। কবি বসন্ত রায়ই বাংলার চিঠিপত্র বৃন্দাবনে নিয়ে যেতেন এবং বৃন্দাবনের জীব গোস্বামী, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখের চিঠি বাংলায় নিয়ে আসতেন। এইভাবে ব্রজ মণ্ডল ও গৌড় মণ্ডলের সংযোগরক্ষক হিসেবে বসন্ত রায় বিশ্বস্ততার সঙ্গে কার্য সম্পাদন করেছেন। রামচন্দ্র কবিরাজ, গোবিন্দদাস কবিরাজের লিখিত পত্রও বসন্ত রায়ের মারফত বৃন্দাবনে পৌঁছতো। পত্রগুলি যদুনন্দন রচিত কর্ণানন্দ এবং নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। তৎকালীন গৌড়ীয় সাধনার ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই পত্রগুলি বিশেষ গুরুত্বের দাবি করতে পারে।


দুই

গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব অনুযায়ী রাধা ও কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দময় এবং রাধা হলেন মহাভাব স্বরূপিণী ও কৃষ্ণ পরম রসিক। তাঁরা উভয়ে এক ছিলেন। রসাস্বাদনের জন্য তাঁরা দুই দেহ ধারণ করে পৃথক হয়েছেন। এই বিশুদ্ধ আনন্দ বা রস আস্বাদন হয়ে উঠেছে ‘লীলা’। চৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে—

   ‘কৃষ্ণের যতেক খেলা সর্বোত্তম নরলীলা নরবপু তাঁহার স্বরূপ। গোপবেশ বেণুকর নবকিশোর নটবর নরলীলা হয় অনুরূপ।।’ ১

অর্থাৎ ভগবানের বিশুদ্ধ ক্রীড়া বা খেলাই হল লীলা। এই লীলারস আস্বাদনের জন্য রাধাকৃষ্ণ যুগলে মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং ব্রজলীলার পরিপূরক হিসেবে চৈতন্য অবতারের মাধ্যমে গৌরলীলাও সংঘটিত হয়েছে। চৈতন্য পরবর্তীকালে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী প্রমুখের দ্বারা রাধাকৃষ্ণের যুগল উপাসনা এই লীলাতত্ত্বের পরিপোষকরূপে বৈষ্ণব সমাজে গৃহীত। ভক্তি উপাসনার দার্শনিক প্রস্থানরূপে গৌড়ীয় ভক্তসমাজে এই অপ্রাকৃত নিত্য রাধাকৃষ্ণ লীলার দিব্য অনুভবকে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। চৈতন্যদেবের সঙ্গে রামানন্দ রায়ের কথোপকথনে এ সম্পর্কিত আলোচনার প্রমাণাদি পাওয়া যায়। মুখ্যত সাধনমার্গের ব্যক্তিদের নিকট এই লীলা রসে পরিণত হয়। আর এই অপ্রাকৃত রসাস্বাদনই ভক্ত বৈষ্ণবদের কৃষ্ণসেবার অন্যতম অঙ্গস্বরূপ।


তিন

এই রাধাকৃষ্ণের লীলাতত্ত্বকে কেন্দ্র করেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের বিস্তার। অনুষঙ্গ হিসেবে সখী, মঞ্জরী, গোপী প্রভৃতি অন্যান্য ব্রজরমণীদের লীলা-সহায়কারিণীরূপে দেখানো হয়েছে। এদের মধ্যে সখীদের স্থান বিশেষভাবে গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত। চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে—

   ‘সখী বিনু এই লীলা পুষ্ট নাহি হয়। সখী লীলা বিস্তারিঞা সখী আস্বাদয়।।

    * * *

   সখীর স্বভাব এক অকথ্য কথন। কৃষ্ণসহ নিজ লীলায় নাহি সখীর মন।।

    * * *

   রাধার স্বরূপ কৃষ্ণ প্রেম কল্পলতা। সখীগণ হয় তার পল্লব পুষ্পপাতা।। কৃষ্ণলীলামৃতে যদি লতাকে সিঞ্চয়। নিজ সুখ হৈতে পল্লবাদ্যের কোটি সুখ হয়।।’ ২

সখীদের গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বে কৃষ্ণসেবার চরম অধিকার দেওয়া হয়েছে। রাধাকৃষ্ণ লীলাকে রসপুষ্টি দান করাই তাদের কাজ। আর রাধাকৃষ্ণের লীলা পরিপূর্ণ হলেই, রসমাধুরীর পরাকাষ্ঠা লাভ করলেই সখীদের যথার্থ তৃপ্তি ও পরিতুষ্টি। যার জন্য কৃষ্ণের প্রেমের কাছে তাদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থতার কোন বাসনাই অনুপস্থিত। আচার্য রাধাগোবিন্দ নাথ বলেছেন—

 ‘সেবার প্রকারভেদে আবার গোপীদিগকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়—সখী ও মঞ্জরী। যাঁহারা স্বীয় অঙ্গদানাদি দ্বারা শ্রীরাধার প্রায় সমজাতীয়া সেবায় শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধান করেন, তাহাদিগকে সখী বলা যায়। ললিতা, বিশাখা প্রভৃতি সখী; ইহারা সকলেই স্বরূপশক্তি। আর যাঁহারা সাধারণতঃ তদ্রূপ করেন না, নিজাঙ্গ দ্বারা সেবা করিতে যাঁহারা কখনো প্রস্তুত নহেন, পরন্তু শ্রীরাধাগোবিন্দের মিলনের ও সেবার আনুকূল্য সম্পাদনই যাঁহারা নিজেদের কর্তব্য বলিয়া মনে করেন, তাঁহাদিগকে মঞ্জরী বলা হয়। ইহারা শ্রীরাধার কিঙ্করী এবং অন্তরঙ্গ সেবার অধিকারিণী। অন্তরঙ্গ সেবায় সখী অপেক্ষাও মঞ্জরীদের অধিকার অনেক বেশি।’ ৩ 

এই সখীদের উৎকর্ষ বিবেচনা করে কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন—

   ‘সখী বিনু এই লীলায় অন্যের নাহি গতি। সখী ভাবে যেই তারে করে অনুগতি।। রাধাকৃষ্ণ কুঞ্জ সেবা সাধ্য সেই পায়। সেই সাধ্য পাইতে আর নাহিক উপায়।।

     * * *

    সেই গোপী ভাবামৃতে যার লোভ হয়। বেদ ধর্ম ত্যজি সে কৃষ্ণ ভজয়।। রাগানুগা মার্গে তাঁরে ভজে যেই জন। সেই জন পায় ব্রজে ব্রজেন্দ্র নন্দন।।

     * * *

    গোপী অনুগতি বিনু ঐশ্বর্য জ্ঞানে। ভজিলেহ নাহি পায় ব্রজেন্দ্র নন্দনে।।’ ৪

 অর্থাৎ ব্রজ-গোপীদের অনুগত হয়ে রাধাকৃষ্ণ সেবাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সাধারণ জীবের সাধনার পন্থা হল সখী বা গোপীর অনুগত হয়ে রাধাকৃষ্ণের কুঞ্জসেবা করা। এই বিশেষ সাধনার নাম ‘রাগানুগা’ ভক্তির সাধনা। কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই ভক্তিসাধনার পন্থাকে অনবদ্য বলে উল্লেখ করেছেন—

   ‘ব্রজলোকের কোনো ভাব লৈঞা যেই ভজে। ভাবযোগ্য দেহ পাঞা কৃষ্ণ পায়ে ব্রজে।।’ ৫

 অর্থাৎ গোপীর অনুগত হয়ে কৃষ্ণ সেবার মাধ্যমে প্রকৃত কৃষ্ণপ্রাপ্তি বা সিদ্ধদেহে রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব বলে কৃষ্ণদাস কবিরাজ স্পষ্টত জানিয়েছেন। এই সাধনধারাকে মঞ্জরী ভাবসাধনাও বলা হয়। বিশেষত দাস্যপ্রেমকে উপজীব্য করে মঞ্জরীভাব সাধনার তত্ত্বটি রূপ লাভ করেছে। পরমপুরুষ তত্ত্ব দুটি সত্তায় আধারিত, ভোক্তা—যিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এবং ভোগ্য হলেন শ্রীরাধা, যিনি তাঁর নারীসত্তা। এই দুইয়ের মাঝখানে তাঁদের লীলারসের পরিপুষ্টির জন্য রাধাকৃষ্ণের সেবায় মঞ্জরীরা কিঙ্করীর অবস্থান গ্রহণ করেন। এই কৃষ্ণসেবা দাস্যপ্রেম তত্ত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই মঞ্জরীগণ কখনোই কৃষ্ণের সঙ্গে নিজ লীলার আকাঙ্ক্ষা করেন না। মূলত এটি গূঢ় সাধনমার্গের এক দার্শনিক ও ক্রিয়াত্মক সাধন ধারার সংমিশ্রিত রূপ। আচার্য নরোত্তম এই সাধনার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন। মূলত রাগানুগা ভক্তির মূল তত্ত্বকে মান্যতা দিয়েই সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক এক মানস-প্রতিক্রিয়া এই সাধনধারার মধ্যে সঞ্চারিত করা হয়েছে। ভজন-রাজ্যে পুরুষ সাধকও তাঁর পুরুষসত্তাকে সাধনার দ্বারা অবলুপ্ত করে নারীভাবে নিজেকে আবিষ্ট করেন। মঞ্জরীভাবের সাধক নিজেকে কল্পনা করেন তিনি বৃন্দাবনের একজন সখীভাব-সমৃদ্ধ মঞ্জরী। মানসজগতে সেই ভাব অবলম্বন করেই তাঁর কৃষ্ণসেবা নির্বাহ হয়। এই ভাবের সাধকদের পুরুষাভিমান ও পুরুষোচিত বৃত্তিসমূহ সাধনার দ্বারা ত্যাগ করতে হয়। মঞ্জরীভাবের অন্যতম সাধক ছিলেন বাংলার ‘শ্যামানন্দ প্রভু’। যাঁর মঞ্জরী ভাবাবেশের কারণে সাধনরাজ্যে নাম হয়েছিল ‘কনকমঞ্জরী’।

মুখ্যত গৌড়ীয় পদকারগণের মধ্যে রাগানুগা ও মঞ্জরীসাধনার বিশেষ একটি প্রভাব চৈতন্য-পরবর্তী যুগের পদাবলীতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সখীর অনুগত ভাব নিয়েই তাঁরা রাধাকৃষ্ণলীলার অপ্রকৃত রস অনুভব করেছেন এবং তাঁদের রচিত পদাবলীতে সেই নিত্যলীলা আখ্যান রূপ লাভ করেছে। সেই জন্য বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে পদরচনা সাধনারই অন্যতম পন্থা এবং পদকবিগণও ‘মহাজন’ আখ্যায় ভূষিত। ভক্ত বৈষ্ণবগণ এই মহাজনদের বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেন। আর বৈষ্ণবকবিগণও তাঁদের ভনিতায় নিজেদের সখীভাব অনুগত করেই লীলারস আস্বাদন করেছেন। বসন্ত রায়ের কতগুলি পদের ভনিতা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে—

‘রায় বসন্ত মন সেবই অনুখন ঐছন চরণ কমল মধু আশে।।’ ৬

‘চরণারবিন্দ নখ চন্দ্রিম সুন্দর রায় বসন্ত চিত হেরই আনন্দে।।’ ৭

‘ঈষত মধুর হাস সরসহি সম্ভাষ রায় বসন্ত পহু রঙ্গিনী বিলাস।।’৮

 ‘রায় বসন্ত কহু রসিক শিরোমণি বিচহি করত উজোর।।’৯

     উপরিউক্ত ভনিতার মধ্যে কবি বসন্ত রায় কতটা অন্তরাবিষ্ট হয়ে লীলারসের আস্বাদন করেছেন তার পরিচয় পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে রাগানুগা ভক্তির ভাব-লক্ষণও ভনিতাগুলির মধ্যে সুপরিস্ফুট, কারণ ভনিতাগুলিতে পদকার কুঞ্জসেবার অধিকার নিয়েই লীলারস আস্বাদনের বর্ণনা দিয়েছেন। সম্ভোগরসের একটি পদের ভনিতায় পাওয়া যাবে পদকার শ্রীরাধাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন কৃষ্ণ সমীপে মিলনের উদ্দেশে যাবার জন্য—

   ‘রসময় নাগর তূহুঁ রস নাগরী এ মধু নিশি পরকাশে। রায় বসন্ত ভনে তেজহ কঠিন পণে পূরাহ কানু মন আশে।।’ ১০

 উপরিউক্ত ভনিতায় লীলাসহায়ক রূপে পদকর্তার উপস্থিতিতে রাগানুগা সাধনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত প্রস্ফুটিত। আরও একটি পদে সখীভাবের অনুগত হয়ে বসন্ত রায় প্রার্থনা করেছেন—

   ‘অনঙ্গ রঙ্গ ভেল দুহুঁ তনু মিলল রায় বসন্ত সখী সঙ্গে।।’ ১১


চার

রাধা ও কৃষ্ণের অভেদত্ব গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের অন্যতম সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে তাঁদের লীলার কারণে পৃথকত্বও স্বীকার্য। এই গৌড়ীয় তত্ত্বের রূপায়ণ ঘটেছে একটি নিবেদন পর্যায়ের পদে—

   ‘তূহুঁ হাম তনু ভিন শ্রবণে জীবন ক্ষীণ কেমনে ধরিবো আমি বুক। হাসিতে মোহিত মন কী মোহিনী তুমি জান বিরমহ দেখি চাঁদমুখ।।’ ১২

পদটির মধ্যে রাধাকৃষ্ণের বিরহ-মিলন সঞ্জাত নিত্যলীলা তত্ত্বের স্পষ্ট রূপায়ণ চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে এই রাধাকৃষ্ণ প্রণয়ের পরকীয়া তত্ত্বেরও স্পষ্ট ছাপ বহু পদাবলীতে পরিস্ফুট। বিতর্কিত হলেও গৌড়ীয় তত্ত্ববাদীগণ পরকীয়া রতিকেই মান্যতা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই সম্বন্ধ কেবল ব্রজ-রমণীদের ক্ষেত্রেই সম্ভবপর অন্যত্র কদাপি নয়। চৈতন্যচরিতামৃতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—

   ‘পরকীয়াভাবে অতি রসের উল্লাস। ব্রজবিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস।।’ ১৩

 প্রেমের নিয়ত প্রতিকূলতা পরকীয়া সম্বন্ধের মধ্যেই রয়েছে। সেইহেতু প্রতিনিয়ত গঞ্জনা-লাঞ্ছনা রাধাকে সহ্য করতে হয়। আর এই নিয়ত যন্ত্রণাকাতরতার মধ্যেই কৃষ্ণপ্রেমের উপলব্ধি চরম আস্বাদ্য হয়ে উঠে—

   ‘গৃহে গুরু গঞ্জন কত নিন্দে বন্ধুজন তাহা মনে পরশ না হোয়। কে আপন কে বা ভিন না বুঝিয়ে দোষ গুণ এ দুখ দহনে দহে মোয়।।’ ১৪

 কৃষ্ণের প্রতি রাধার আত্যন্তিক অনুরাগ লীলাতত্ত্বেরই অন্যতম রূপায়ণ। এই লীলার পারম্যই গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে ক্রমশ প্রসারিত হয়ে রস পর্যায়ের বিভিন্ন স্তর পরম্পরা নির্মাণ করেছে। যার মধ্যে রসিক ও রসের এক অপার্থিব বিরহ-মিলনের সম্পর্ক বর্তমান। সেখানে পরম রসিকও রসের জন্য বিরহ অনুভব করেন, আবার রসও রসিকের জন্য প্রতীক্ষমাণ। এই তত্ত্বের অনুভবযোগ্য রূপ খুঁজে পাওয়া যাবে বহু পদে। রাধা কৃষ্ণকে বলেছেন—

   ‘তোহারি গরবে ব্রজে হাম গরবিনী। গহীন পিরীতি তোর আমি কিবা জানি।।’ ১৫

আবার কৃষ্ণও বলেছেন—

   ‘তোমার মিলন মোর পুণ্য পুঞ্জ রাশি। না দেখিলে নিমিখে শতেক যুগ বাসি।।’ ১৬

 গৌড়ীয় সখী তত্ত্বের স্পষ্ট রূপ খুঁজে পাওয়া যাবে কয়েকটি পদে। যেখানে সখীরা ঘনিষ্টভাবে রাধাকে প্রবোধ দিচ্ছে এবং মিলনের জন্য সুসজ্জিত করছে—

   ‘সুন্দরী থির কর আপনক চিত। কানু অনুরাগে অথির যব হোয়বি কৈছে বুঝবি তছু রীত।।

     * * *

   এত কহি বেশ বনায়ত সহচরী সুন্দরী চিত থির ভেল। অভিসার লাগিয়া সমুচিত উপহার রায় বসন্ত কত কেল।।’ ১৭

 সখীদের রাধাকে অভিসারের উদ্দেশে সুসজ্জিত করার নিপুণ চিত্র একটি পদে পাওয়া যায়। যেটি সখীদের মূল কার্যপ্রণালীকে রসানুগতভাবে তুলে ধরে—

   ‘সখীক বচনে ধনী হিয়া আনন্দিত পিয়া মিলন অভিলাষে। নয়ন বয়ন পুন পরশ বিলোকন সহচরী পরম উল্লাসে। কেহ কঙ্কতি করে কেশ বেশ করু কবরী মালতী মালে। করি করে দর্পণ বদন বিলোকই বিমল করত সিঁথি ভালে।।’ ১৮

অভিসার যাত্রার জন্য সখীরা রাধাকে বিবিধ বসন-ভূষণে সুসজ্জিত করে তুলছে। কৃষ্ণ সুখের হেতুই এ হেন রূপসজ্জা। সখীদের পরম আনন্দও এর মধ্যে ফুটে উঠেছে। তারা রাধাকৃষ্ণের আনন্দমুখর মিলনেই আন্তরিকভাবে সুখী।

 বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণবতার মূল সাধনাদর্শ সখীভাবের বা মঞ্জরীভাবের সাধনাই মহাজন কবি বসন্ত রায়ের পদাবলীতে আদ্যন্ত পরিস্ফুট। যার দরুন আমাদের অনুসন্ধানে যত বসন্ত রায়ের পদাবলীর প্রাপ্তি ঘটেছে তার মধ্যে অধিকাংশই মধুর রসের পদ। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতের এক স্থানে বলেছেন—

   ‘গুণাধিক্যে স্বাদাধিক্য বাঢ়ে প্রতি রসে। শান্ত দাস্য সখ্যাদির গুণ মধুরেতে বৈসে।।’ ১৯

অর্থাৎ মধুর রসই অন্যান্য রসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কারণ অন্যান্য রসের গুণও তার মধ্যে বিদ্যমান। উপরন্ত মধুর রসের নিজস্বতার ক্ষেত্রটিও নেহাত স্বল্পায়ত নয়। সেই তত্ত্বকে মান্যতা দিয়েই বসন্ত রায় মধুর রসের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করেছেন। যার জন্য সখ্য কিংবা বাৎসল্য রস বসন্ত রায়ের পদাবলীতে অপেক্ষাকৃত স্বল্প গুরুত্ব পেয়েছে। 




তথ্যসূত্র

১। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মধ্যলীলা একাদশ পরিচ্ছদ [সুকুমার সেন ও তারাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পা:] প্রথম আনন্দ সংস্করণ ১৩৩২, আনন্দ, কলকাতা, পৃ: ৩২২

২। তদেব, মধ্যলীলা অষ্টম পরিচ্ছেদ, পৃ: ১৮৪

৩। রাধাগোবিন্দ নাথ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের ভূমিকা, সংস্কৃত বুকডিপো সংস্করণ ১৪২২, সংস্কৃত বুকডিপো, কলকাতা, পৃ: ১২০

৪। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, মধ্যলীলা অষ্টম পরিচ্ছেদ, পৃ: ১৮৪

৫। তদেব, পৃ: ১৮৪

৬। অক্ষয় চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পা: প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ, প্রথম প্রকাশ ১২৯১, ৩৪/১ নং কলুটোলা স্ট্রিট, বঙ্গবাসী মেশিন প্রেসে পূর্ণচন্দ্র দত্ত দ্বারা মুদ্রিত,পদসংখ্যা ২০৩, পৃ: ৬৮

৭। তদেব, পদসংখ্যা ২০৫, পৃ: ৬৮

৮। তদেব, পদসংখ্যা ২০৭, পৃ: ৬৯

৯। তদেব, পদসংখ্যা ২০৭, পৃ: ৬৯

১০। তদেব, পদসংখ্যা ২০৮, পৃ: ৬৫

১১। তদেব, পদসংখ্যা ২৩২, পৃ: ৭৬

১২। তদেব, পদসংখ্যা ২৩১, পৃ: ৭৫

১৩। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা- অষ্টম পরিচ্ছদ, পৃ: ১৮৬

১৪। অক্ষয় চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পা: পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পদসংখ্যা ১৯৬, পৃ: ৬৭

১৫। তদেব, পদসংখ্যা ২৪১, পৃ: ৭৭

১৬। তদেব, পদসংখ্যা ২৪১, পৃ: ৭৭

১৭। তদেব, পদসংখ্যা ২১৫, পৃ: ৭১

১৮। তদেব, পদসংখ্যা ২১৬, পৃ: ৭১


12 Oct 2024

মালঝিটা নিয়ে দু এক কথা 


পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সংরক্ষিত "মাদলাপাঞ্জি" থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে মালঝিটা দণ্ডপাঠ সমগ্র উৎকল রাজ্যের ৩১ টি দন্ড পাঠের মধ্যে অন্যতম একটি দন্ডপাট হিসেবে পরিগণিত হতো । যে ছ'টি দণ্ডপাঠ নিয়ে অভিভক্ত মেদিনীপুর জেলার চৌহদী গঠিত হয়েছিল তার মধ্যে বর্তমান দিঘা থানা ও রামনগর থানা ,কাঁথি থানা ,খেজুরি থানা ভগবানপুর থানা সমেত এগরা থানার একাংশ নিয়ে এই মালঝিটা দণ্ডপাট গঠিত হয় ।

 মালঝিটার নামকরণের প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে যে বিস্তীর্ণ সুউচ্চ বালির অবস্থান ষাঁড়ের ককুদের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো বলেই মালঝিটার নাম করন হয়ে থাকার কথা অনেকেই মত পোষণ করেন ।

 বাহাদুর মনমোহন চক্রবর্তী তার  (History of Orissa in the 16th century by Rai Bahadur Manmohan Chakraborty ) বইতে ভাগীরথী ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল ঘেঁষে রূপনারায়ন থেকে সুবর্ণরেখা নদী পর্যন্ত মালঝিটা অঞ্চলের বিস্তার লাভের কথা উল্লেখ করেছেন l

উভয় "আইনী আকবরী" ও "চৈতন্যচরিতামৃত" গ্রন্থে মালঝিটা দণ্ডপাট বা মহাল কিংবা লবণাক্ত পরগণা কথার স্পষ্ট উল্লেখ আছে । O'Malley তাঁর মেদিনীপুর গেজেটিয়ার বইতে পৃষ্টা ২৬ ,৮৩ ,১৮৩,২০১ আদিতে Maljyatha mahal বা Dandapat ভাবে দেখিয়েছেন ।

১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবর বঙ্গদেশ অধিকার করার পরে বাহিরিকে কেন্দ্র করে মালঝিটার হিন্দু রাজা দের প্রায় তিনশো বৎসর রাজ্য শাসনের পর পাঠান বংশীয় রাজত্ব কালে হিজলী খণ্ডের রাজধানী কসবা- হিজলি তে স্থানান্তরিত হয় । পরবর্তী সময়ে রাজস্ব সংস্কারের নিরীখে মাল্যঝিটার অঞ্চল সমুহের পুনর্বিভাজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে মালঝিটার ভৌগলিক অস্তিত্ব । হারিয়ে যায়নি মালঝিটা ভাষার বিন্যাস , বিস্তার ও স্বাদ ।

ভৌগলিক অবস্থানের ফলে মালঝিটা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা উড়িয়া প্রাধান্য বাংলা মিশ্রিত একটি স্বতন্ত্র ভাষা রূপ নিয়েছে যে ভাষা সমগ্র বঙ্গদেশের সর্ব জন গ্রাহ্য চলতিভাষা বা standard language এর সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তিত হওয়ার প্রয়োজন বা তাগিদ অনুভব করেনি । তাই এই ধরনের আত্মসন্তুষ্ট , সাবলিল এবং পরিবর্তন বিমুখ একটি ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে যে ভাষায় স্বতন্ত্রতা এবং নিজস্ব একটি পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে 

কৃপসিন্ধু মিশ্র মালঝিটা ভাষার বরেণ্য কবি ভাবে চিহ্নিত  বহু পৌরাণিক পালা, নাটিকা ও গানের তিনি স্রষ্টা l বহু কাল কবির সৃষ্টি মামাদৃত ও তাঁর কবি প্রতিভা মহিমা মন্ডিত l

কৃপাসিন্ধুর পরবর্তী সময়ে মালঝিটা ভাষার চর্চা ও লেখন নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য লেখা আছে বলে মনে হয়না । সীমিত অঞ্চলের গণ্ডির মধ্যে আটকে গেছে এই ভাষার মর্যাদা ।  পরবর্তী সময়ে এই ভাষা মূলত কথিত ভাষা হিসেবেই থেকে গেছে সেই ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে কোন কিছু উল্লেখযোগ্য তেমন লিখা হয়নি । তবে পরবর্তী সময়ে মালঝিটা ভাষায় লিখিত হয়েছে গুণধর করের নাটক " সীতার পাতাল প্রবেশ " । এই নাটক কৃপাসিন্ধু নাটকের মডেল করেই লিখা আগাগোড়া ওড়িআ নাটক বাংলা লিপিতে । লেখার ধরন অনুযায়ী গানে ভণীতার মাধ্যমে কৃপাসিন্ধুর নাম উল্লেখ আছে আবার কোথাও কোথাও গুনাধরের উল্লেখ করা আছে । এরপরে মালঝিটা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে একটা দীর্ঘ সময় ধরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য নাটক বা পালা নজরে আপাতত আসেনি । ১৯৭০ দশকের পরবর্তী সময়ে বালিসাইর অজিত দাস , দীঘার নিখিল চন্দ্র সামন্ত মালঝিটা ভাষায় কিছু গান আকাশবাণীতে পরিবেশন করার নজির স্থাপন করেন । তারপরে ১৯ ৯০ দশকে সন্তোষ কর লিখে ফেললেন বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সমুদ্র কেন্দ্রিক জেলে জীবন নির্ভর একটি উপন্যাস" দাঁড় জাল মুক্তামাছ" । তিনি আবার ফিরিয়ে এনেছেন হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি মধুর মাটির কাছের মালঝিটা ভাষা এই বইটিতে । আর তাতেই বাজিমাত করে দিয়েছেন রুপকার সন্তোষ কর । বিশেষত" দাঁড় জাল মুক্তামাছ" উপন্যাসের মুল চরিত্রদের মুখে দারুন মিনিয়েছে আঞ্চলিক মালঝিটা ভাষা । ম্যাজিকের মত কাজ করেছে এই প্রচেষ্টা । গৌরবের বিষয় "দাঁড় জাল মুক্তামাছ" রাঁচির ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বিশ্ব বিদ্যালযের পাঠ্যসূচিতে সামিল হয়েছে l

সমসাময়িক সময়ে মালঝিটা ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা যে কজন চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তখন কুমার রঞ্জিত । তপনবাবুর" পাঁচমেশালি " কবিতা সংকলন ও বিভিন্ন প্রবন্ধ মালঝিটার আঙ্গিনায় প্রশংসার দাবিদার । বিভিন্ন লেখায় এই ভাষার গৌরব এবং ইতিহাস তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক গৌতম প্রামানিক আবার বলাইলাল ত্রিপাঠী  পেশায় শিক্ষক বাঞ্ছানিধি শুঁই , রমণিকান্ত পাত্র ,প্রভুরাম প্রধান  ও প্রয়াত আইনজীবী পরিতোষ সামন্ত।

সমসাময়িক সময়ে মালঝিটা ভাষার নীরব সাধনায় যে দু জন মগ্ন তার মধ্যে এই মহকুমার স্বনাম ধন্য আদী কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্রের র ছায়া স্পষ্ট প্রতীয়মান l এই প্রান্তীয় মিশ্র ভাষায় লেখা লিখে যান আপন মনে l মালঝিটা ভাষার  ব্রতী দুই স্রষ্টা  -আশুতোষ দাসে এবং তপন কুমার রণজিৎ l উভয়ের  কবিতা তুলে ধরতে চাইছি -


আশুতোষ দাসের তিনটি কবিতা 

জহ্নরে ফুটিচ্ছি জহ্নি ফুল 


শুন হে জহ্নমামু শরদ শশী,

তুম কুলে আম পুঅ খেলিব বসি l

ভারত মাতার ছুআ চন্দ্রযান তিন

২৩শ সনরে ছুয়া মো গলা সেদিন l

আম পুঅ তুম পাখরে রহিব খুশি --

ধন্য ধন্য জহ্নমামু তুমকু কহিবি, 

 খেলিবাকু দেইচ নুয়া নুয়া ছবি l

কেতে কথা কুহে পুও শুনে জগৎবাসী 

দক্ষিন আড়িরে পুও মো ঘুরি বুলুচি,

আকা সাকা কেহি নাই ডর মাডুচি 

কাঁহি গল চাঁদ বুড়ি দেখা কর শীঘ্র আশি--

একেলা রহিব সে ১৪ ঘড়ি নিশার,

কাহারি কু নাহি ডর রহিছি ফাঁকার l

এ পুওকু লেই গর্ব ভারতবাসী

মো বালুত কেমন্তে জানিব ,

চাঁদবুড়ি সে দেখা ন দেব l

ভারত মাতার বড় গর্ব শূনুছি বিদেশী --

শুন চাঁদবুড়ি ছুয়ার মো কিছি হেলে,

দায়ী রহিব তুম্ভে চির কালে l

বালুত কু চাহিছি মো দেশবাসী--

কলঙ্ক তুমোর সেমেস্তে জানে 

আউ কি কলঙ্ক লোবো তু ম জীবনে 

যা করিব দেখিবো জগত বাসী 

জগত সভার মো ভারত মাতার

শ্রেষ্ঠ আসন তার দেখে বিশ্ববাসী। 


নজরুল ।

                                       

বিদ্রোহী কবি তুমে তম কবিতারে 

বিদ্রোহ উঠে ফুটি।

দেশদ্রোহী নুহ তুমে দরিয়া লহরী 

বিপ্লবী আসে ছুটি।

তুমে কবি তুমে দাবা নল শিখা 

জালিচি বহ্নি তুমরি কবিতা

তুমে শৈল গিরি যাই চড়ি

তু মোরি কবিতারে আসে স্বাধীনতা

তুমে ভাগিচ লুহার কবাট

উন্নত করি শির

তুমে ছিড়িছ লোহার শৃংখল 

ভদিচ লক্ষ তীর ।

কারা ঘর তার ইটার পাঁজর

খন্ডে খন্ডে দেল খুলি

উজানী উঠিলা, বিপ্লবী ঘর 

ফিরিঙ্গি বাধারে মারুচি গুলি ।

সমেস্তে শহীদ হেইচি

বাকি অচ্ছি মোগবুল

ডরিবার নাহি কেহি

কুহু অছি নজরুল ।


মহাবাট। 


চাঁহি দেখ আগ পট 

জীবনর মহা বাট ।

চালি পারুচি নি মু 

এ বড় কঠিন বাট। 

বাপ মা দারা সূত 

হস খেল মনঃপুত। 

বসাই চু মহাহাট 

কেহি নাই তো পাঁ ই 

জীবা বেলে কিছি নাই।

দুই খণ্ড কাঁচা কাঠ 

পচারি লে তাকু ডাকি 

সে ডাকরে ন দবু ফাঁকি ।

কেইঠি বসিচি তার হরিহাট।


-------------------------------------------------

পুরণা বাটো

    - তপনকুমার রণজিৎ


পুরণা বাটো-ঘাটো গোলা হজি,

সড়়ক উপরো লয়া লয়া ঘর-বাড়ি ৷

হাটুয়া হাটো খুঁজে--

খুঁজে বালিয়াড়ি উপরো পুরণা বাটো ৷


পঁতেইঘাটো কতরো থিলা শ্বশুরো ঘরো,

ঘরো থিলা তার দেপাল হাটো পাখরো ৷

বাপো -মা, শাশু-শ্বশুরো- কেভে চালি যাইচন !

দেখা হেই নাই বঙ্গ-উৎকল সীমা 


হাটুয়া হাটো খুঁজে,

খুঁজে বালিয়াড়ি উপরো পুরণা বাটো ৷

খুঁজে তার বাপ-ঠাকুরদা'র ঘরো ৷

জন্ম যে তার বীরকুলরো,

জগৎ কুহে 'বীরকুলা' ৷


পুরণা বাটো ধরি, 

লয়া সড়ক উপরো উঠি -

ঘুরি দেখে ভাষা অছি, নাই তার লিপি --

এ দুঃখ যে বীরকুলা'র !


পুরণা বাটো-ঘাটো গোলা হজি,

সড়ক উপরো লয়া লয়া ঘরবাড়ি ৷

" উঠিলা সুয়ারি বসিলা নাই,

ঘুরি তকিইবাকু বাপো ঘরো নাই ৷"


জহ্নরে ফুটিছি জহ্নি ফুল

শুন হে জহ্নমামু শরদ শশী,

তুম কুলে আম পুঅ খেলিব বসি l

ভারত মাতার ছুআ চন্দ্রযান তিন

২৩শ সনরে ছুয়া মো গলা সেদিন l

আম পুঅ তুম পাখরে রহিব খুশি --

ধন্য ধন্য জহ্নমামু তুমকু কহিবি,


আলেখ্য বরুণ কুমার দাস 

স্মৃতির আঙিনায় বরেণ্য কবি জয়ন্ত মহাপাত্র


                                                               () বরুণ কুমার দাস 

"পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ার জন্য আমি লেখা বা কবিতা নিয়ে কিছুই জানতাম না l বাস্তবে আমার পত্নী ছিলো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী l আমি যেহেতু ইংরেজী তে পড়াশোনা করেছিলাম তাই আমি শব্দ গুলোর যথার্থ প্রয়োগ করে লেখার সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম l বেশ কিছু লিখেছি , গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রকাশিত ও হয়েছে কিন্তু আমি জানিনা কিভাবে অমি এই কাজটি করতে পারলাম l"

'আমি মনেকরি ওড়িশা কে বাদ দিয়ে অন্য কোনোও রাজ্যাকে ভালো বেসেছি l আমার বিদেশে অবস্থান নিয়ে আনেক সুযোগ ছিলো l যখন আমার বিশিষ্ট কবি বন্ধু এ কে রামানুজন আর আর পার্থসারথি বিদেশে থেকে গেছেন সেখানে আমি ওড়িশা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি l আমি ভালো বেসেছি আমার রাজ্যের আবহাওয়া , তার বাতাস আর তার বৃষ্টিকে l এই ৯৪ বছর বয়সেও অমার বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে l আজকেও আমি বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম l"


একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক । সময়টা ইংরেজি ২০১৩ সাল । রামনগর কলেজের ইংরেজি বিভাগ এগরার শারদা শশী ভূষণ কলেজের যৌথ প্রচেষ্টা ও ইউ জি সি র সহযোগিতায় একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয় ইং ১৩ আর ১৪মে ll সেই সেমিনারের মধ্যমণি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি জয়ন্ত মহাপাত্র l ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক অধ্যাপক এবং রিসার্চ স্কলারদের আগমন হয় । গ্রাম্য পরিবেশে একটি কলেজে এই ধরনের একজন বিশিষ্ট কবির আগমনকে অনেকে ব্যঙ্গ করে , অনেকের মনে অবিশ্বাস জন্মায় , কেউ মেনে নিতে পারে না যে তিনি হয়তো আদবেই এখানে আসতে পারবেন বা আসবেন l কিন্তু সবার পরিহাস ,ব্যঙ্গ ,বিদ্রূপ এবং আশংকার অবসান ঘটিয়ে তিনি কিন্তু উপস্থিত হন l সাদরে কবিকে পুস্প স্তবক আর চন্দন দিয়ে বরণ করে নেয় রামনগর কলেজে । কলেজের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা অধ্যক্ষ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের আন্তরিক অভ্যর্থনার অভিভূত হন কবি l কবির খুব ভালো লাগে এখানকার পরিবেশ এবং অতিথি অবর্ধনা । বরেণ্য কবি কে নিজের বাসভবন কটক শহরের তিন কনিয়া বগিচা থেকে গাড়িযোগে আমি সঙ্গে নিয়ে আসি কলেজে l দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেক কথা হয় অনেক অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করি সেদিনের সেই কথাগুলো আমার কাছে চিরকালই সম্পদ হয়ে থাকবে l ভদ্রকে চা পান , বালেশ্বরে টিফিন সঙ্গে ছিলাম আমি আর সেদিনের মূল্যবান প্রহর l সন্ধ্যা নাগাদ দিঘায় পৌঁছায় আমরা l হোটেলে কবিকে রাখার সবকিছুই ব্যবস্থা ছিল ইংরেজি বিভাগের তরফে । সব দিক দিয়েই যাতে কবির কোন সমস্যা না হয় নজর দেওয়া ছিল এবং সমস্ত ব্যবস্থাপনা যথার্থ করার চেষ্টা ছিল l রামনগর করেজের অধ্যক্ষ ড. অনন্ত মোহন মিশ্র , ইংরেজী বিভাগীয় প্রধান ড .সুতনু কুমার মহাপাত্র সমেত বিভাগের অধ্যাপক সত্য সুন্দর সামন্ত ও বিশ্বজিৎ করের অকুণ্ঠ প্রচেষ্টায় সেমিনার অনান্য মাত্রা পেয়েছিল । কবি সেমিনারে অংশগ্রহণ করেই খুব আনন্দ লাভ করেন l বিশেষ ভাবে আয়োজিত প্রশ্ন উত্তর আসরে ও কবি উপস্থিত সমস্ত গুণীজনের প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর যথার্থভাবে দেন l সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা এবং সম্পর্ক স্থাপন করেন l খুব কাছ থেকে কবিকে দেখতে পাওয়া এবং খুব কাছ থেকে কবির সান্নিধ্য পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার l সবাই বরেণ্য কবির উপস্থিতি মন ভরে উপভোগ করেছিলেন সে দিন l জয়ন্ত মহাপাত্রের খুব ভালো লেগেছিল এখানকার ঘরুয়া পরিবেশ , আপ্যায়ন ,ও আন্তরিকতা l সমস্ত অনুষ্ঠানটির আগাগোড়া ভিডিও রেকর্ডিং কারার ব্যবস্থা ছিল । রামনগর কলেজের অ্যাপায়ন এতটাই কবিকে প্রভাবিত করেছিল কবি আবার একবার আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি সেটা অপূর্ণ থেকে গেছে অপূর্ণ থেকে গেল সব দিনের জন্য  । কবিকে খুব কাছ থেকে দেখেই মনে হতো তিনি খুব কাছের ঘরের মানুষ এত বড় একজন কবির সামান্য টুকুও অহমিকা বোধ ছিল না সবার সঙ্গে খুব মিশে যেতেন আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনে ছিল না একটুও কিন্তু ভাব  l তিনি ছিলেন মাটির মানুষ কটক ছিল বর্ণপরিচয় তাই সাধারণ মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা  কবিতার শব্দে শব্দে ভরেছিল ।


    () এক নজরে কবিকে দেখে নেওয়া যাক......

জন্ম ২২ অক্টোবর ,১৯২৮, কটক শহরের পিটন সাহি l বাবা -স্যামুয়েল মহাপাত্র , মা -সুধাংশু বালা দাস l পত্নীর নাম রুনু ( জ্যোৎস্না)মহাপাত্র এবং এক মাত্র পুত্রের নাম মোহন মহাপাত্র l প্রথমে স্টুয়ার্ট স্কুল পরে রিভেন্সা কলেজ তার পরে পাটনা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে এম এসি l সহ সম্পাদক ভাবে দ্য ইস্টার্ন টাইমস দিয়ে শুরু ,পরে রেভেন্সা , ফকির মোহন কলেজ , গঙ্গাধর মেহের কলেজ , বি জে বি কলেজ এবং শেষে রিভেনসা থেকে অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসর নেন ১৯৮৬ সালে l


প্রকাশিত পুস্তক

ক্লোজ টু স্কাই টেন বাই টেন ১৯৭১, এ রেন অফ রাইটস ১৯৭৬, ওয়েটিং ১৯৭৯ , দা ফলস স্টার্ট ১৯৮০

রিলেশনশিপ ১৯৮০, লাইভ সাইন্স ১৯৮৩, হুয়াইটনেস অফ বন ১৯৯২ , বেআর ফেস ২০০০ ,দ্য রেন্ডম ডিসেন্ট ২০০৫ , ল্যান্ড ২০১৩ , হেসিটান লাইট ২০১৬ ,

স্কাই উইদাউট স্কাই : দ্য পুরী পোয়েমস (২০১৮)

অনুবাদ 

উইংস অফ পাস্ট ১৯৭৬, সংস অফ কব্জা এন্ড আদার পোয়েমস ১৯৮১ ,

আই ক্যান বাট হুয়াই সুড আই গো ( শক্তি চটটোপাধ্যায়ের কবিতার ইংরেজী অনুবাদ ) নতুন দিল্লি ,১৯৯৪

তপশ্বনি: এ পয়েম ,১৯৯৮

পুরস্কার

দেশ-বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠিত সংস্থা পত্রপত্রিকা বিশিষ্ট কবি কে সম্মানিত করেছে লন্ডন শিকাগো জাপান থেকেও তিনি বিভিন্ন পুরস্কার সম্মানিত হয়েছে হাজার ১৯ ৮১ তে নিজের কাব্যগ্রন্থ রিলেশনশিপের জন্য পেয়েছেন কেন্দ্র সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার , এবং পরবর্তী সময়ে সম্মানজনক পদ্মশ্রী পুরস্কার থেকে শুরু করে ওড়িশার এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন এবং পুরস্কার লাভ করেছেন ।


**** বালেশ্বর জেলা ভোগরাই থেকে তরুণ কুমার দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা শামুকা ১৯৯৫ সালের শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই লেখকের নেয়া জয়ন্ত মহাপাত্রের সঙ্গে একটা বিশেষ সাক্ষাৎকার । সেদিনের সেই বিশেষ সাক্ষাৎকারের কিছু নির্বাচিত অংশ এই প্রতিবেদনে সংযোজিত করছি----

প্রশ্ন: আপনি বলেন একটা একটা কবিতা যদি পাঠক কিছুই যাই সেটাই বড় বলে মনে হয় তাহলে এইখানে বলুন আপনার কবিতায় পাঠকের জন্য কি বার্তা থাকে ?

উত্তর : মাটির কথা আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থানে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের ব্যথা যন্ত্রণা জীবন সংস্কৃতি ভাষাভাব এবং সাধারণ জীবনের নানা ছন্দ নানা রম নানারূপ রূপায়িত হয় কবিতায় । ভোলা বাহুল্য নিজের আশেপাশের কথাগুলো সাধারণ মানুষের কথাগুলো যদি সহজেই পাঠকের কাছে পৌঁছে না দেওয়া যেতে পারে তাহলে সে কবিতা না কবিতা হতে পারে না । মাটির প্রতি আনুগত্য থাকাটা খুব জরুরী কবি সেটা দায়িত্ব সাধারণ জীবনের সমস্ত কথাগুলো তুলে ধরা ।

প্রশ্ন: একটা ভালো বা সফল কবিতার সংজ্ঞা কিভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে কিভাবে আমরা বলতে পারি এই কবিতাটা বেশ সুন্দর বা উপযোগী ?

উত্তর : সামান্য হেসে কবিতার সংজ্ঞ া কিংবা স্বরূপ মূল্যায়ন করাটা খুব সহজ কাজ নয় তবে কোন কিছু সঙ্গাই যথেষ্ট নয় সার্থক কবিতার জন্য মনে করুন এই মুহূর্তে একটা লেখা আমি লিখলাম ভালো লাগছে আবার পরের মুহূর্তে সেই কবিতার ভালো লাগছে না মনের মধ্যে এরকম ভাবনা আছে যে আরো হয়তো ভালো লিখা দিত ভালো লিখতে পারতাম মূল ব্যাপার হচ্ছে কবিতার মূল্যায়ন আসল মূল্যায়ন পাঠকের কাছেই আছে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে না পারলে কবিতা সাড়া না জাগালে সে কবিতা কবিতা নয় আমার লিখাই আমি সাধারণ মানুষের কথা মাটির কথা আন্তরিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি সেই ভাষায় যে ভাষায় মাধ্যম করে কবিতা পৌঁছে দেবে দেশ দেশান্তর ।

প্রশ্ন : লিখেন ইংরেজিতে কবিতা পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কিন্তু আপনার কবিতায় ওড়িশার বা ভারতের সমস্ত কথাগুলো যেন প্রাধান্য পেয়েছে এ যেন ভারতীয় চিন্তা চেতনার নির্যাস ,কি বলবেন ?

উত্তর: দেখুন আমি অটকে থাকি কটক এ জন্য কটকেই বড় হয়েছি। কটক আমার বর্ণপরিচয় বলে ধরতে পারে তাই কটকের বাইরের জগত নিয়ে আমি কি করে বলতে পারি যা কিছু বলেছি এইখানকার উড়িষ্যার বা ভারতে চিন্তা চেতনা কেন্দ্রিক বিশেষত কটক কেন্দ্রে তাই আমি মনে করি লোকসম্পর্ক কিংবা পাঠকের আত্মাকে স্পর্শ যদি না করতে পারি আমার কবিতার মাধ্যমে তাহলে আমি আমার কথা বলে আনন্দ হতো না তাই আমি আমার কথাগুলো আমার বেদনা গুলো একবারে মাটির কাছ থেকেই বলার চেষ্টা করেছি ।

প্রশ্ন: দুঃখ বেদনা এবং মৃত্যু আপনার কে কিভাবে প্রভাবিত করেছে আপনি এগুলো নিয়ে কিভাবে ভেবেছেন ?

উত্তর: ঠিকঠাক করে কি বলা যায় বলা মুশকিল তবে এই উপাদান গুলি নিশ্চিত ভাবে বিভিন্ন মুহূর্তে ভাবায় আন্দোলিত করে প্রভাব ফেলে সাহিত্যে প্রয়োগ যথেষ্ট ব্যাপক এবং বহুরূপী দুঃখ-বেদনা সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক খুব জানতে পারলেও সে সেই রকমই রহস্যময় সব দিনের জন্য ।



অনুবাদে কবির লেখা কবিতা 


               Hand       : অনুবাদক : মনোজিৎ দাস ।।


ছোট্ট মেয়েটার হাতটা অন্ধকারে মোড়া

আমি কি ভাবে তার হাত ধরি ?


রাস্তার বাতিটা ঝুলছে মাথার উপর আঘাতের মতো - 

ভীষণ ভাবে রক্ত ঝরাচ্ছে আমার দুজনের মধ্যে ।


দেশের প্রশস্ত মুখের মধ্যে যন্ত্রণার বন্ধনী - 

যদিও তার শরীরটা শুকনো দুঃখের জীবন।


ছোট্ট মেয়েটা যার পোশাক হীন দুমড়ানো শরীর আমার কাছে চলে আসে।


আমার দোষী শরীরটা অক্ষম হলেও পরাস্থ করে,

প্রতিরোধ করে তাকে আলিঙ্গন করতে।।

## Freedom ##

Written by Jayanta Mahapatra.( The most famous indian poet )

অনুবাদক : মনোজিৎ দাস।


একটা সময় আমি লক্ষ্য করি 

আমার দেশের শরীরটা

ভেসে চলে নদীর উপর নিরুদেশে,আমাকে একা রেখে।

নদীর মধ্যে অর্দ্ধেক অবতীর্ণ

ডুবে থাকা বাঁশের উপর

আমি বাড়তে থাকি।

এখানে বিধবারা ও মৃতপ্রায় লোকেরা প্রার্থনা করে মুক্তির জন্যে - 

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে ,

উপাসনায় অবিচল থাকে।

যদিও শিশুরা লালন পালন হয় মুক্তির স্বাদকে আস্বাদন করতে,পৃথিবীর উপর হাত না রেখে।


এক এক সময় আমি ভয় পাই

আমার অন্ধত্বে - 

আমি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই,

ফিরে আসি ওদের সাথে

যখন ওদের মুখগুলোর কথা

মনে রাখতে পারিনা - 

তখন ভীষণ একা হয়ে যাই।

ঐ সব মহিলা ও তাদের সন্তানদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি না।

যারা দূরের গ্রামে, পাহাড়ের নিচে বাস করে

দু ' মুঠো অন্ন ওদের জোটে না

এক বেলা আহার জোটে না

পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতায়।

সংসদ কক্ষে সাদা স্তম্ভগুলি দাঁড়িয়ে আছে রক্তাত্ব সূর্যাস্ত কে আঁকড়ে ধরে আছে।


কাছেই নতুন মন্দির - 

একজন ব্রাম্ভন,

সে শুধু চায় মুক্তি চায়

যদিও ভগবান লুকিয়ে আছেন অন্ধকারে।

প্রতিদিন আমি আলোর সন্ধান খুঁজি ,

ছায়া শুধু অজুহাত দেখায়।

খোঁজার চেষ্টা করছি সেই মুক্তিকে,

যে সমগ্র শরীরকে মুক্তি দেবে

নরম শীলার নিঃশব্দ মুক্তি।

চাঁদহীন কয়লা 

ঘুমন্ত ঈশ্বরের ঝর্নার শয্যা । 

আমি ছাই গুলোকে সরিয়ে রাখি ,চেষ্টা করি না নিজের কপালে রাখতে।।

## Twilight #

By Jayanta Mahapatra.

অনুবাদক: মনোজিৎ দাস।।


হাসপাতালের বিবর্ণ ফলক গুলোতে,

কমলা রং বিস্তার হয়েছে

দিনবসানের শেষ লগ্নে

যদিও অন্ধকার নামেনি।।


ছেলেমেয়েদের ভাষা

মায়ের মুখের মধ্যে

মৃত্যু, সেতো সবসময় যৌবন!

জলের কল্ কল্ শব্দ নদীর গলায়।।


এই কান্না কি ক্ষমা ভাগকরে নেওয়ার অভিশাপ?


কোথাও গোধূলির আলো পড়ে শুভ্র জুঁই ফুল ফোটার।।


রাস্তা ছাড়িয়ে বাড়িগুলোর উপর বাতি জ্বলে ওঠে,

আগষ্ট মাসের ভেজা সন্ধ্যায়

আমাকে জড়িয়ে রাখে -

আমার স্পর্শ কাতর হাত দুটো

এক অজানা বিশালত্বের দিকে।।

পরিশেষে দু-একটা কথা পরিবেষন করে এই প্রতিবেদন শেষ করতে চাইছি । বরেণ্য কবি ধর্ম ধারনা নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন , অস্তিত্ব নিয়ে ছিল লড়াই , বেদনা আর একাকিত্ব ছিলো নিত্য সঙ্গী l কবি জীবন সঙ্গিনী রুনু কে হারিয়ে ছিলেন ২০০৮ সালে , একমাত্র ছেলের মৃত্যু হয় ২০১৮ নাগাদ আর কবি নিজে করনায় আক্রান্ত হোন ২০২০ তে l সব কিছুর প্রতিফলন কবিতায় বিভিন্নভাবে রূপায়িত হয়েছে । বিশেষ করে কবির লেখা শেষ ইচ্ছা পত্র - তাতে তিনি যে কথাগুলি বলেছেন সে বিষয়ে আমি যাচ্ছি না । কবির ধর্ম নিয়েও প্রশ্ন হয়েছে হিন্দু না খ্রিস্টান । আবার ইংরেজিতে লিখতেন বলে সাধারণ পাঠক থেকে তৈরি হয়েছে দূরত্ব তাই নিজে কবি জীবনের শেষের দিকে বেশ কিছু বছর অনেক কবিতা লিখেছেন ওড়িআতে ,চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের খুব কাছে পৌঁছে যাওয়ার যেহেতু ভাষাটা একটা বড় ভূমিকা রাখে । আমি মনে করি শেষের দিকে লিখা ওড়িআ কবিতাগুলো যথারীতি আলাদা মাত্রা এবং বৈশিষ্ট্য বহন করে কবিকে বোঝার ক্ষেত্রে । নিজের ধর্মপত্নী মৃত্যু শয্যায় তিনি ভালো চিকিৎসা দেওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেও আশানুরূপ সাহায্য পাননি বলে কবির ক্ষোভ আছে , অভিমান আছে বেশ কিছু মানুষজনের উদাসীনতার জন্য ,ক্ষোভ আছে কবিকে এক ঘরে বা দূরে সরিয়ে রাখার জন্য । বিশ্বর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কবিকে যে মর্যাদা দিতে পেরেছে আমার মনে হয় আশানুরূপ কটক দিতে পারেনি যে কটক ছিল কবির রচনার পট্টভূমি , কবির জীবনের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বিস্তার l বর্ণ পরিচয়ের সম ছিলো কটক শহর । বালেশ্বরের প্রতি কবির টান চিরদিনের - বিশিষ্ট কবি শ্রীদেব থেকে এই প্রতিবেদক এবং বালেশ্বরে অবস্থিত ফকির মোহন বিশ্ববিদ্যালয় অবধি তা পরিব্যাপ্ত । এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির নামে নামাঙ্কিত একটি আলাদা গ্যালারি আছে যেখানে কবির সমস্ত বই চিঠিপত্র এবং অন্যান্য জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখা আছে । করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই কবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা ভিতর দিয়ে যেতে থাকেন । শেষে বার আমি ২০২১ সালের মাঝ বরাবর সময় কবির বাস ভবনে যাই । কবিকে খুব দূর্বল হয়ে অর্ধ উলংগ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখি । আমাকে দেখে খানিকটা উঠে বসার চেষ্টা করে বলেন - "বরুণ দিহ ভল যাউনি , কিছি মনে করনা , পরে আসিব কথা হেবি "। এই অবস্থায় ছবি তলোর অগ্রাহ্য লঘু করে প্রমাণ জানিয়ে পরিচারিকা আম্মা র হাতে সংগে নিয়ে যাওয়া সামান্য কিছু দিয়ে ফিরে এলাম । দূরে সরে যেতে থাকে কবির প্রিয় বসত বাড়ি চান্দ্রভাগা , তিন কোনিয়া বাগিচা , কটক শহরের নিত্য দিনের শব্দ মুখর ব্যস্ত জীবন । একাধিকবার ফোনের সমস্যার জন্য শেষের দিকে কবির সঙ্গে ঠিক মতন যোগাযোগ করে উঠা সম্ভব হয়নি । শেষ ল্যান্ড ফোন ওপার প্রান্ত থেকে কয়েকটি শব্দ যা শুনতে পেয়ে ছিলাম জুলাই ২০২৩ --"ফোনের কিছু শুনি পাইনি , পরে কথা হব" , এপ্রান্ত থেকে আমার কথা আর যেতে পারলনা ,আর কোনো দিন ও যেতে পার বে না । এর পর যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বার বার বিঘ্নিত হয়েছে বিভিন্ন কাজের নিরিখে  l শেষবারের মতন আর কবির সঙ্গে দেখা সম্ভব হলো না তিনি চলে গেলেন l নিজের অনন্য সৃষ্টিতেই বেঁচে থাকবেন কবি অনন্তকাল l 


ঋণ প্রাপ্তি

Express News Service 15 May ,2022

The Criterion An International Journal in English vol 3,, issue 4,Dec 2012

The Revati magazine , Balasore

The Shamuka sharadiya issue Oct 1995

The Frontline article

The chandrabhaga WhatsApp Group

Personal Contact with the poet over 20years

The Doinik Chetana Bengali Daily

Dr.Sutanu Kumar Mahapatra & Dr. Dijendra Nath Suine 

The Shreyashii online magazine ISSN 25814079

The prameya Odia Daily


 





X