গল্প
*বসন্তের রঙ সাদা*
সন্তু জানা ।
বসন্তের রং লেগেছে লাল পলাশ গাছটির সারা দেহ জুড়ে । চারিদিকে রঙিন আঁকিবুকি আর প্রকৃতির কোলাজ । বাতাস বইছে ফুরফুরে মেজাজে । পাশেই ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিন । প্রতিদিনের একঘেয়েমি ভিড়ের চেনা দৃশ্য । একেবারে কোণে একটি টেবিলে একা ঠায় বসে আছে বছর তেইশের এক তরুণ । নাম অসীম । আজকে, এক কাপ গরম কফিতে চুমুক দিতেও যেন ভুলে গিয়েছে সে । সত্যি কি পারুলের ফোনটা আর আসবে না আজ ! সত্যি কি গতকাল তার বিয়েটা হয়েই গিয়েছে !
"স্যার, টোস্ট দিয়ে যাবো ?" , ওয়েটার ছেলেটি নরম করে বলে উঠল ।
অসীমের অন্যমনস্ক চোখের চাউনি অসম্মতি জানালো । ধীরে ধীরে টেবিলের উপর কফির মগ থেকে ধোঁয়া কমে আসছে । তারপর একটা সময় একদম হিমশীতল জলের মতো ঠান্ডা । সকালের আলতো সূর্য এখন অনেকটা ওপরে । কিন্তু, অসীমের চরিত্রের কোনো পট-পরিবর্তন নেই । এদিকে, ঘড়ির কাঁটার গতি রোধ করে সাধ্য কার । সময় যেন প্রাণপণে ছুটছে সামনের দিকে । হঠাৎ ক্যান্টিনের মালিক ইতস্তত হয়ে ছুটে এসে বাঁজখাই গলায় বলে উঠল, "দাদা, অনেক হয়েছে, এবার তো টেবিলটা ছাড়তে হবে না কি ? কিছুই তো নিচ্ছেন না দেখছি ।"
বলতে বলতে হঠাৎ করে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো --- " আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে, ভোরের আলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে......" । অবশেষে, ওপার থেকে পারুলের সেই আদুরে গলা , "আসু, আমি সক্কাল সক্কাল শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে গেছি । আর, জানিস, এসেই নতুন বউয়ের হাতে তৈরি গরম গরম কফি সার্ভ করছি । তুই সকালে কফি খেয়েছিস তো ? আসু.......?"
কোন বাক্য নেই । কোন শব্দ নেই । শুধু এক ফোঁটা জল চোখ থেকে সরে গিয়ে জায়গা করে নিল ওই ঠান্ডা কফির অতল সাগরে । ক্যান্টিনের পাশের রঙিন পলাশ গাছ থেকে একটা শুকনো ফুল ঝরে পড়লো অসীমের শরীরে । আবছা চোখে অসীম দেখলো, ফুলটির রঙ সাদা !
দাঁতন, মেদিনীপুর, ৭২১৪২৬ ।
পশ্চিমবঙ্গ ।
ভারত ।।
বো ধ ন
পদ্মলোচন করণ
মহালয়ার পর দুদিন অতিক্রান্ত। আর পাঁচদিন পর মহাপূজোর বোধন। সর্বত্র আনন্দ মূখরিত পরিবেশ। পূজোর কেনাকাটা চলছে পূরোদমে। প্রসাদবাবুর কাপড়ের দোকানে ভিড় ক্রমশঃ বাড়ছে। শেষ মুহুর্তের কেনাকাটায় সবাই ব্যস্ত। বিশেষ করে মেয়েরা আর ছোটরা রঙ্গিন জামাকাপড় পরে দোকানের জৌলুষ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
পূজোর আগের শেষ রবিবার বলে সেদিন দোকানে লোকজনের আনাগোনা বেশি। কাউন্টারে বসা ছেলেটির থেকে একটু তফাতে বসে আছেন প্রসাদবাবু। তাঁর সামনে দিয়েই কাচের দরজা ঠেলে
সবাই ঢুকছে বেরোচ্ছে। স্বচ্ছ কাচের দরজা দিয়ে যেমন পাশ দিয়ে যাওয়া বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছে , তেমনি দেখা যাচ্ছে উন্মুক্ত আকাশের অনেকটা
অংশ।
এখন বিকেল। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘগুলো থরে থরে সাজানো। অপরাহ্নের মোলায়েম সাদা ও হালকা লাল মেশানো রশ্মিচ্ছটা
সেই মেঘের উপর পড়ে বেশ সুন্দর ও মোহময় দেখাচ্ছে। পূজোর আনন্দ আকাশে বাতাসে - এ যেন তারই উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
প্রসাদবাবু রোজই এসব দেখেন। বড় ভালো লাগে তাঁর। লোকজনের আনাগোনার ফাঁকে ফাঁকে সারা বিকেলটা কেমন করে রং পাল্টিয়ে ক্রমশঃ বিমর্ষ হয়ে ধীরে ধীরে সন্ধ্যের দিকে এগিয়ে যায় -
স্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে তাঁর দৃষ্টিতে। যেদিন দোকান বন্ধ থাকে , দোতালার বারান্দায় বসে সেই একই দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কেটে যায় তাঁর।
আজও সেই একই ভাবে সময় অতিক্রান্ত হচ্ছিল। হঠাৎ প্রসাদবাবুর নজরে পড়ল - দরজার ওপারে রাস্তার ধার ঘেঁষে তাঁরই দোকানের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি পনেরো ষোল বছরের মেয়ে এবং সঙ্গে সম্ভবতঃ তার ছোট ভাই। দুজনের পরনে অতি সাধারন জামাকাপড়। অনেকক্ষন ধরে ওদের দুজনকে নিরীক্ষন করলেন প্রসাদবাবু। তাঁর মনে হল ওরা ভেতরে আসতে চায়
কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।
প্রসাদবাবু উঠে পড়লেন। দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে কাছে আসতে দেখেই মেয়েটি কিছুটা সংকুচিত হয়ে ভাইকে একটা হাতে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল।
প্রসাদবাবু ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন - এই মেয়ে - অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছো দেখছি। ভেতরে গিয়ে কিছু কিনবে ?
মেয়েটি সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বলল - হ্যাঁ কাকু- তোমার দোকানে আমার ভাই এর জন্য জামা পাওয়া যাবে ?
প্রসাদবাবু ওর ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন - নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এসো দোকানে এসো। অনেক জামা আছে - পছন্দ করে কেনো।
ওদের দুজনকে নিয়ে দোকানের ভেতর গেলেন তিনি। একজন কর্মচারীকে ওদের সাথে দিয়ে মেয়েটিকে বললেন - যাও মা - ভাইয়ের জন্য জামা পছন্দ করে নিয়ে এসো।
ওরা ভেতরে চলে গেলে প্রসাদবাবু নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। অনেক লোকের ভিড়ে তাঁর দোকান এখন গমগম করছে।
বেশ কিছুক্ষন পর মেয়েটি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। জামা কেনে নি। মুখে বিমর্ষ ভাব।
প্রসাদবাবু ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন - কি হল মা - জামা কিনলে না যে ?
মেয়েটি সামান্য ইতস্ততঃ করে হতাশ স্বরে বলল - না কাকু -
কেন - কি হল ? প্রসাদবাবু প্রশ্ন করলেন।
মেয়েটি বলল - আমার যে জামা পছন্দ হল - ভাই সেটা নেবে না। আর ভাইয়ের যেটা পছন্দ হল - আমি কিনতে পারব না। আমার কাছে এত টাকা নেই।
প্রসাদবাবু বুঝলেন ব্যাপারটা। অনেকেই তো দাম বেশি হলে না কিনে ফেরৎ চলে যায়। ওতে কোনদিন তাঁর কিছু মনে হয় না। আজ কিন্তু তাঁর সেরকম মনে হল না। কিছুটা উৎসুক হয়ে তিনি ওদের দুজনকে একপাশে ডেকে নিলেন।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন - তোমার নাম কি মা ?
মেয়েটি বলল - সায়নী -
ভাইয়ের নাম ?
সায়নী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল - বল না তোর নাম ?
ভাই এবার প্রসাদবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল - সন্দীপ দাস।
বেশ - বেশ - তা তোমরা দুজনে কেনাকাটা করতে এসেছো যে - তোমাদের বাবা - মা -
সায়নী মুখ নিচু করে বলল - আমাদের বাবা মা দুছর আগে গাড়ী এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।
প্রসাদবাবু হঠাৎ দমে গিয়ে অনেকটা চুপসে গেলেন। ঢোঁক গিলে বললেন - তোমাদের আর কেউ নেই ?
সায়নী বলল - না কাকু , আর কে থাকবে ? আমি আর ভাই আছি।
তোমাদের বাড়ী কোথায় ?
সায়নী বলল - ঐ বড়পোলের ওপারে। জেঠু আমাদের বাড়ীটা নিয়ে নিয়েছে। শুধু একটা ঘরে আমরা দুজন থাকি।
প্রসাদবাবু বললেন - তুমি কি কর ?
সায়নী উত্তর দিল - আমি কয়েকজন ছোট ছেলেমেয়েকে পড়াই। ভাইও আমার কাছে পড়ে।
প্রসাদবাবু জিজ্ঞেস করলেন - কতদূর পড়েছো তুমি ?
বারো ক্লাসে পড়ছিলাম -
পড়ছিলাম মানে ? এখন পড় না ?
সায়নী সপ্রতিভ ভাবে বলল - না কাকু পড়ব কি করে ? আমাদের টাকা নেই।
প্রসাদবাবু চুপ করে গেলেন। মনে পড়ল ঠিক পাঁচ বছর আগে এই পূজোর সময়েই তাঁর একমাত্র মেয়ে মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল। লক্ষ টাকা খরচ করেও তিনি তাকে বাঁচাতে পারেন নি। বেঁচে থাকলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটির মতোই বয়স হত। নিজের অজান্তে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস তাঁর বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। মেয়ের স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই তিনি কেমন আনমনা হয়ে গেলেন।
হঠাৎ তাঁর চমক ভাঙ্গল সায়নীর কথায়। সায়নী তখন বলছে - কাকু , আমরা এখন যাই ?
প্রসাদবাবু উঠে দাঁড়ালেন। ছোট্ট সন্দীপের মাথায় হাত রেখে বললেন - এসো তো বাবা আমার সঙ্গে। কোন জামা পছন্দ করেছিলে আমাকে দেখাও তো । সায়নী - তুমিও এসো।
ওদের দুজনকে নিয়ে দোকানের ভেতর ঢুকে ছেলেদের অনেক জামা বার করলেন প্রসাদবাবু। সবগুলো সন্দীপকে দেখিয়ে বললেন - এবার বলতো কোনটি তোমার পছন্দ ?
সন্দীপ হাত বাড়িয়ে নির্দিষ্ট জামা দেখিয়ে দিল। প্রসাদবাবু জামাটা তুলে নিয়ে কর্মচারীকে কাউন্টারে পাঠিয়ে দিতে বললেন।
এবার প্রসাদবাবু দুজনকে নিয়ে মেয়েদের পোষাকের জায়গায় গেলেন। সেখানে থরে থরে সাজানো প্রচুর রঙ্গিন সুন্দর নানান্ পোষাক।
প্রসাদবাবু সায়নীকে সস্নেহে বললেন - মা - কোনটি তোমার পছন্দ আমাকে বল তো ?
এত সুন্দর পোষাকের সম্ভার দেখে সায়নীর চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু মুখে সে সব প্রকাশ না করে শুধু বিরস ভাবে বলল - আমি জামা কিনবো না কাকু।
প্রসাদবাবু বললেন - কেন কিনবে না মা ?
সায়নী মুখ নিচু করে বলল - আমার পূরনো একটা জামা আছে - তাতেই হয়ে যাবে। আসলে ভাই বায়না ধরেছিল বলে ভাইয়ের জন্যই এসেছিলাম।
প্রসাদবাবু মুখে কিছু না বলে একটা সুন্দর দেখে চুড়িদার জামা বার করে বললেন - দেখো তো মা - এটা নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ হবে। নাও - এটা
তোমায় দিলাম।
সায়নী মুখ নিচু করে অত্যন্ত সসঙ্কোচে বলল - না কাকু - আমি নেবো না।
প্রসাদবাবু নিজে ওখানে দাঁড়িয়েছিলেন বলে কর্মচারীরা একটু তফাতে সরে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে তিনি সায়নীকে বললেন - মা , তোমার বাবা
যদি তোমাকে জামা দিত - তুমি না বলতে পারতে ? আমাকে কাকু বললেও মনে কর না কেন তোমার বাবাই তোমাকে জামা দিচ্ছেন।
মুখ নিচু থাকা অবস্থাতেই এবার সায়নীর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ত্বরিতে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে প্রসাদবাবুর দিকে তাকালো সে।
প্রসাদবাবু সেই দৃষ্টিতে কি নিজের মেয়ের অবয়ব দেখতে পাচ্ছেন ? নিজ হাতে পূজোর জামা কিনে দিচ্ছেন নিজের মেয়েকে ?
এক অদ্ভুত ভাবাবেগে তাঁর সমস্ত হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠল। কর্মচারীকে ডেকে শুধু বললেন - জামাটা কাউন্টারে পাঠিয়ে দাও।
জামার প্যাকেট নিয়ে ভাই বোন যখন দোকান থেকে বেরিয়ে গেল তখন প্রসাদবাবুর মনে হল - তাঁর এত বছরের ব্যবসায়িক জীবনে আজকের দিনটাই সবচেয়ে সার্থক দিন। তিনি অনুভব করলেন - এক অনাবিল তৃপ্তিতে তাঁর মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ।
পূজোর শুরু থেকে লক্ষীপূজো পর্যন্ত প্রসাদবাবুর দোকান বন্ধ থাকে। কর্মচারীরা ঐ সময় ছুটিতে থাকে। এই কদিন প্রসাদবাবুরও পরিপূর্ণ বিশ্রাম।
মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় শহরের সমস্ত রাস্তাঘাট আলোকমালায় সুসজ্জিত। বড় থেকে ছোট সবাই যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে। মন্ডপে মন্ডপে ভিড়ের মাঝখানে মাইকের সুরেলা আওয়াজ। ষষ্ঠীর আনন্দঘন পরিবেশে মাতোয়ারা সবাই।
প্রসাদবাবু দোতালার বারান্দায় বসে রাস্তার আলো ঝলমল এই জনজোয়ার দুচোখ ভরে উপভোগ করছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় একা হয়ে পড়েছেন তিনি। তাই ছুটির দিনে শুধু সন্ধ্যের সময়টুকু ছাড়া খুব একটা বাইরে বেরোন না। ইচ্ছে আছে আজও একটু রাত হলেই সামনের মন্ডপে গিয়ে দেবী দর্শন করে আসবেন।
সিঁড়ির বন্ধ দরজায় কে যেন ঠক ঠক শব্দ করছে। তখন সবে সন্ধ্যা নামছে। চারদিকে উজ্জ্বল আলোর রোশনাইয়ে অন্ধকার কোথাও নেই। বরং সবকিছুর ঔজ্জ্বল্য অনেকগুন বেড়ে গিয়েছে।
উঠে পড়ে সিঁড়ির দরজাটা খুলে দিয়েই চমকে উঠলেন প্রসাদবাবু। দরজার ওপারে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সায়নী ও সন্দীপ। পরনে তাঁরই দেওয়া নতুন পোষাক।
অত্যন্ত খুশী হয়ে প্রসাদবাবু বলে উঠলেন - তোমরা এসেছো ? এসো - এসো , ভেতরে এসো। ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছো বুঝি ?
সায়নী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল - হঁ্যা কাকু - ভাবলাম ঠাকুরকে প্রণাম করার আগে তোমাকে প্রণাম করে যাই। তাই চলে এলাম।
বলেই দুজনে নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল তাঁকে।
এক অনির্বচনীয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে দুজনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন প্রসাদবাবু। তাঁর মনে হল জীবনে সব হারিয়েও আবার তাঁর সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে। এত সুখ , এত তৃপ্তি তিনি
কিভাবে ধরে রাখবেন ?
সায়নী একমুখ হাসি নিয়ে বলল - কাকু , বললে না তো কেমন লাগছে আমাদের ?
প্রসাদবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন - খুব ভালো - খুব সুন্দর । তোমরাই তো পূজোর আনন্দ - আমারও আনন্দ।
সায়নী বলল - আসি কাকু - ভাইকে কয়েকটা ঠাকুর দেখিয়ে নিয়ে আসি। দেরী হলে রাত হয়ে যাবে। তুমি ঠাকুর দেখতে যাবে না ?
প্রসাদবাবু বললেন - যাবো বইকি - তোমরা যাও , আমি একটু পরে বেরোবো। মনে মনে বললেন - আমার ঠাকুর দেখা এইমাত্র হয়ে গিয়েছে। আর কোন কিছুর দেখার প্রয়োজন নেই।
তাহলে আমরা এখন আসি কাকু। বলেই সিঁড়ির কাছে গিয়ে দুজনেই তরতর করে নামতে লাগল।
ওদের পেছন পেছন প্রসাদবাবুও নিচে নামলেন। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে তৃপ্তিভরে ওদের চলে যাওয়া দেখলেন প্রসাদবাবু।
লোকজনের ভিড়ে ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে চোখ তুলে আকাশ পানে তাকালেন প্রসাদবাবু। সেখানে অসীম শূন্যতায় ভেসে রয়েছে উজ্জ্বল একফালি চাঁদ। তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য তারার মালা। সেই তারার আলোর পথ ধরে নীল দিগন্তের কোন এক প্রান্ত থেকে যেন ভেসে আসছে মৃদু দুন্দুভীর সাথে সুমধূর সংগীত
লহরী দেবী দূর্গার বোধনের - আজ এইমাত্র তাঁর মনের গভীরে যে বোধন হয়ে গেল ছোট্ট ভাইবোনের মিষ্টি হাসির মধ্য দিয়ে ।
-----------
গ্রাম - টেংরামারী
পোঃ- বোধড়া
জেলা- পূর্ব মেদিনীপুর-৭২১৪২৩
মোবাইল - 9432656635
Mail- [email protected]
দান
জয়নাল আবেদিন
শামীম শেখের গতরপাতে জমিতে সোনা ফলে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যায়। লাঙ্গল- গরুতে জমি চষা। বীজ বপন। ধান- পাট-কলাই। শস্য ফলানো, মাথায় ঘাম পায়ে ফেলার পরিশ্রমে। বাড়িতে শামীম শেখের বিবি খাদিজা। স্বামীর দোসর পরিশ্রমের নিরিখে। সংসারের কাজ, জোড়া গরুর খড় কাটা। গোয়ালসাফাই, তার সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুই ছেলে একটু বড় হলে বাপের সঙ্গে জমিতে যায়। বাপের কাছে কাজ শেখে। একটু একটু হাত লাগায়। সারাবছরের ফল- ফসল বিক্রির টাকায় একটু একটু জমিয়ে জমি বেড়েছে কয়েক বিঘা। এখন শামীম শেখের ডাঙা থেকে নেমে এক বন্দে তেরো বিঘা জমি। আরও চার বিঘা রয়েছে খালপাড়ের লাগোয়া। বয়স বেড়েছে শামিম শেখের। জোয়ান হয়েছে দুই ছেলে। তারাও ঠিক বাপের মতই কর্মঠ। বাপকে আর জমিতে যেতে দেয় না এখন। শামীম শেখ এখন মসজিদ মুখো। শেষ জীবনটা ধর্মের প্রতি টান এসেছে। দান- ধ্যানে বেশ মনোযোগী। অবসর সময়টা ধর্মে- কর্মেই কাটাতে চায়। পাড়ার শেষ প্রান্তের জবির খানের মেয়ের বিয়ে। এক মন চাল সাহায্য দেবে কথা দেয় শামীম শেখ। কিন্তু বাধ সাধে বিবি, ছেলে দুজন। এভাবে দানে বাধা দেয় বাপকে। - এভাবে দান ছত্র খুলে দেয়া যাবে না। বড় ছেলের প্রতিবাদ।- কেন রে? অসুবিধের কি ? বাপের প্রশ্ন।- দু-চার কিলো দাও। তাবলে এক মন ? ছোট ছেলের জবাব। গুম খেয়ে যায় শামীম শেখ। এমন পরিস্থিতি শেষ বয়সে বড় ধাক্কা দেয় তাকে। যার সিল তার নোড়া - তারই ভাঙবি দাঁতের গোড়া ! জৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহে পরপর দুদিন বেশ বৃষ্টি হলোো। চাষীদের তৎপরতা বাড়লো, ধানের বীজ ফেলার। ফজরের নামাজ শেষে, সকাল সকাল কাঁধে লাঙল নিয়ে গরু জোড়াকে তাড়িয়ে জমিতে গেল শামীম শেখ। বিবির নজরে পড়তে হকচকিয়ে গেল সে। ছুটে গিয়ে ডাকে ছেলেদের। ছেলেদের আপত্তি কানে দিলে না শামীম শেখ। গরু তাড়িয়ে লাঙ্গল চষতে থাকে দমের সঙ্গে।আবারো যেন চাষের জমিতে পুরনো শক্তি ফিরে পায়। পরপর তিনদিন জমি চষতে থাকে। ঘাস- পাত মেরে বীজ ধান ফেলল জমিতে। বাড়িতে একটু একা একা সময় কাটায় শামীম শেখ। নামাজ শেষে তসবিহ করে। কাছে আসা মানুষগুলোকে নিয়ে আলোচনা করে। ভরা মরশুমে নিজের হাতে চষা জমিতে, মজুর নিয়ে এসে ধান রোপণ করে। ছেলেরাও তাদের মতো কাজ করে। কোন ক্লান্তি নেই শামীম শেখের শরীরে। দমে তো কোন টান নাই এই বয়সে। ফসল উঠেছে খামারে। সোনালী ধানে খামার ভরা। ছাড়াই- মাড়াই চলছে সকাল থেকে। কয়েকটা মজুর কাজ করে চলেছে পরপর কয়েকদিন। বস্তা বোঝাই ধান ছেলে দুজন গোলা ভরাচ্ছে। হঠাৎ ই জবির খাঁয়ের দেখা মেলে সামনের রাস্তায়।-- জবির ভাই, শোনো- শোনো । যাও কোথায় ? হাঁক দেয় শামীম শেখ। - বল দাদা ? ডাকলে আমাকে ?-- হ্যাঁ গো, শোনো ভাই । মাফ করে দিও আমাকে, গেল বছর মেয়ের বিয়ের সময় কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। আজ এক বস্তা ধান দিচ্ছি। সেদ্ধ শুকনো করে মেয়ে জামাইকে খাওয়াবে।- আমি নিয়ে যাব কি করে দাদা। বিস্ময়ে জবির খাঁন।-- তুমি নিয়ে যাবে কেন গো ? আমার লোক তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবে। এই যা তো, এর বাড়িতে এক বস্তা ধান দিয়ে আয়। তুমি এদের সঙ্গে যাও। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি শামিম শেখের। ছেলে দুজন তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
________________________জয়নাল আবেদিনশাঁখ পুকুর মাঝের পাড়াবজ বজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণাকোলকাতা-৭০০১৩৭মোবাইল-৯০০৭৯৫০০১৬
মন উতাল করা বিকেল গুলো
জয়ন্ত কুমার মল্লিক
গ্রীষ্মের বিকেলগুলো বড় লম্বা-চওড়া, দীর্ঘ ক্ষণ স্থায়ী হয়। বর্ষাকালের বিকেলগুলো মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলায় মাতলেও বেশিরভাগ বিকেলে মেঘের ঘনঘটা থাকায় খুব নিষ্প্রভ আর ম্রিয়মাণ লাগে। উজ্জ্বল শীতের বিকেল গুলো বড়ই ক্ষণস্থায়ী। প্রায় আড়াই তিন দশক আগে বিকেলে ভোরের ফুল নামেএকটি বাংলা চলচ্চিত্র তৈরি হয়। আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম, সুকণ্ঠি আরতি মুখোপাধ্যায়ের সুললিত কন্ঠে এই জনপ্রিয় গানটি বেশ নস্টালজিক। জীবনের বিকেলবেলা বলতে মধ্যবয়স প্রৌর্ঢ়ত্ব বার্ধক্যের কাছাকাছি অবস্থা বোঝাতে পারে। কিন্তু আমার এই নিবন্ধ আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সোনালী বিকেল গুলো নিয়ে । মন ভালো করা বিকেলবেলাগুলোকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬৫ বছরের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই মন কেমন করা বিকেলগুলো স্মৃতিচারণ স্মৃতিরোমন্থন করবএই ছোট্ট কলেবর বিশিষ্ট লেখনীতে।
খুব ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে। তখন প্রাইমারিতে পড়ি । সকালে স্কুল, বিকেল নাগাদ বাড়িতে বাড়িতে চা তৈরির জন্য উনুনে কাঠ কয়লা ঘুটে কেরোসিনের সমারোহে চতুর্দিকে ধোঁয়ায় ভরে যেত। আরেকটা বিকেল আসার প্রতীক্ষায় আমরা মুখিয়ে থাকতাম কারণ তখন শুধু বিকেলবেলাতেই বাড়ি থেকে বেরোনোর অনুমতি মিলত। মা জেঠিমার কাছ থেকে ১০ পয়সা নিয়ে ঝাল মুড়ি, ফুচকা (তখন দশ পয়সায় পাঁচটা) কিনে খেতাম তারপর সিজন অনুযায়ী ভাই বন্ধুবান্ধব ও পাড়ার সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে ফুটবল অর্থাৎ পায়ে বল ও ক্রিকেট খেলতাম। এরপর প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক স্কুলের আঙিনায় প্রবেশ। বিকেল হলে স্কুলের খোলা জানলা দিয়ে বাইরের উজ্জ্বল সোনা ঝরা আকাশটাকে দেখতাম। ভাবতাম কখন বাড়ি ফিরে প্রিয়জনদের মুখ গুলো দেখবো আর কিছু খেয়ে বাড়ির সম্মুখস্থ রাস্তায় খেলতে নামব। খেলতে খেলতে সন্ধ্যে নামলে খুবই দুঃখ পেতাম। ভাবতাম বিকেলটা আরেকটু স্থায়ী হলে আরেকটু খেলা যাবে আনন্দ সঞ্চয় করা যাবে নতুবা আবার পরের বিকেলের জন্য প্রতীক্ষা। জীবনের এক সময় বহুদিন হেস্টিংস রেসকোর্সের মাঠে জার্সি বুট পড়ে ফুটবল খেলেছি।
এরপর কলেজ ইউনিভার্সিটির জীবনে প্রবেশ করে অনেক সোনালী বিকেল কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কলেজ বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করেছি। সেই আড্ডায় আলোচনায় উঠে এসেছে পড়াশোনা সাহিত্য খেলাধুলা সিনেমা রাজনীতি আরো কত কি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার আগেই কফি হাউসের কোলাহল মুখরিত ঘর ছেড়ে গাড়ি ধরে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। আবার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর কর্মজীবনে প্রবেশ করার মুহূর্ত পাড়ায় খেলাধূলা করেছি এবং কখনো কখনো কোন কোন দিন পাড়ার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে রকে বসে গাল-গল্পে মেতেছি ।তখন একটা বিকেল অন্তর্হিত হয়ে আরও একটা সন্ধ্যার জন্ম দিয়েছে।
কর্মজীবনে প্রবেশ করে স্কুল শিক্ষক হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে পড়াতে কতশত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার পথে বিকেলে মাঠে ময়দানে কলকাকলি রত ছেলেদের হইচই কলরব শুনে মন ভরে উঠেছে। মন বলে উঠেছে -
Such Such were the joys
when we l all girls and boys
in our youth time were seen
on the echoing Green- By William Blake .
অনেক বিকেলে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল এর ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শুনতে এবং পরবর্তীকালে ঘরে টিভিতে খেলা দেখতে পাড়ার সবাই বাড়িতে জড়ো হত, বস্তুত আমাদের প্রতি ভালোবাসার টানে। এমনিভাবেই জীবনের ৬৪টি বসন্ত পেরিয়ে এসেছি। অবসর জীবনে প্রবেশ করার পর আর বিকেলের কাছ থেকে কোন আলাদা ডাক পাইনা। একটু বেরোনো হাটাহাটি ওষুধ খেকো শরীরটাকে একটু ফিট রাখার সামান্যতম প্রয়াস। পথে বা মাঠে ছেলেদের খেলতে দেখলে আজ মন কেমন করে। মনে হয় মাঠে নেমে যাই। মনে হয় জীবনে সেই দুরন্ত কৈশোর ও যৌবনকে যেন ফিরে পাই কিন্তু বয়েস সায় দেয় না। আমার এই জীবনে এখনকার বিকেলগুলো যেন তাদের মহিমা হারিয়েছে তবু পড়ন্ত বিকেলে চুঁয়ে পড়া সূর্যের মিষ্টি রোদের দিকে তাকিয়ে আজও অনুপ্রাণিত হই আবেগ তাড়িত হই। ঝরে যাওয়া বিকেলে পাখিদের কলরব করতে করতে নীল আকাশের বুক চিরে নীড়ে ফেরার লগ্নে মনে হয় আবারো কি জীবনের ওই পুরনো দিনগুলো ফিরে পাওয়া যাবে না, অনেক অনেক অর্থের বিনিময়ে ? মন খারাপ করা মন কেমন করা মন উতাল করা হারিয়ে যাওয়া সোনালী বিকেলগুলো আজও আসে চলে যায় আমার জন্য কো
ন নতুন বার্তা না রেখে।
() 673 এ হিন্দুস্থান পার্ক ডায়মন্ডহারবার রোড বেহালা কলকাতা ৭০০০০৩৪ তারিখ ২৯/৯/২০২৪।
অসিত খাটুয়া
দীঘার কাছে অবস্থিত রামনগর কলেজের দর্শন বিভাগের স্যাক্ট টিচার l নিয়মিত অণুগল্প লিখেন l মনন সাহিত্য পত্রিকা সংগে যুক্ত, খোলাপাতা, শ্রেয়সী সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে l
হাইপার অ্যাসিডিটি অসিত খাটুয়া
প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে শোভন লেখা-পড়ায় খুব ভালো। ক্লাসে সে প্রথম-দ্বিতীয় হত। শেষ পর্যন্ত ফিজিক্সে M.Sc, Ph.D করার প্র ছাত্র জীবন শেষ করল। কিছু দিন কৃচ্ছতাসাধন করার পর এক মফৎসলের কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগদান করে। গর্বিত বাবা-মা তার বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে। এহেন ব্যচিলারের জন্য অনেক কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজীবন দুঃখে লালিত পীড়িত শোভন পরবর্তী জীবন সুখের জন্য আধুনিক লাস্যময়ী রাজন্যাকে বিয়ে করে।
বিয়ের কয়েকটা মাস যেতে না যেতে শোভনের বাবা হাইপার অ্যাসিডিটির ফলে স্ট্রোকে মারা যায়। এত দিন বাবার সংসারে থেকে শোভন যতটা নিরাপদ বোধ করতো, এখন তা আর হয় না। বাকী জীবনটা একটু অন্য রকম ভাবতে শুরু করে। মোটা মাইনার চাকুরি তাকে স্বপ্ন দেখায়, এতে সায় দেয় তার স্ত্রী। এক রকম স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে শোভন জায়গার দালাল ধরে একটি পছন্দ মতো শহরে জায়গা কেনে। ইতি মধ্যে রাজন্যার কোলে মিষ্টি কিউটি এল। এদিকে বাড়ি শুরু করে। বছর দুইয়ের মধ্যে এক সুন্দর রাজস্থানী পাথর বসানো বাড়ী তৈরি করে।
গৃহ প্রবেশের কত বন্ধু-বান্ধব এল, ভুরিভোজ, ধূম-ধাম করে গৃহ প্রবেশ হল। শোভন মশলা দেওয়া তৈলাক্ত খাওয়ার খেয়েছে। জল কম পান করেছে। প্রসাদে কলা, দুধ, নানান ফলমুল খেয়েছে। ঘুম ঠিকঠাক হয় নি। পরে দিন বুক জ্বালা, গ্যাস-অম্বল, বমি হয়ে হাইপার অ্যাসিডিটিতে অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তার বলে রোগীর সিরিয়াস আবস্থা। ৭২ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। শোভনের প্যারালাইস হয়ে যায়। বাম সাইডের হাত ও পা অবস হয়ে যায়। বহু দিন ফিজিও থেরাপী করে খুড়ীয়ে খুড়ীয়ে লাঠী নিয়ে হাঁটে ।
এখন শোভন ফোর হূইলার রাখা ঘরের পাশে হূইল চেয়ার নিয়ে বিকালে বসে থাকে। চোখে জল আসে। আর ভাবে, অনেক পরিশ্রম করে চাকুরি পেলাম, পুরো জীবন চাকুরিটা উপভোগ করতে পারলাম না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করলাম, স্ত্রীর সঙ্গে পাহাড়ে সেলফি তুলতে পারলাম না।অনেক ব্যয় করে বাড়ী তৈরী করলাম, খোলা ছাদে গিয়ে আশ্বিনের পূর্নিমার চাঁদ দেখা হল না।
এমন কি মেয়ে কিউটির হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতে পারলাম না। এই অসহায় জীবনের কথা ভেবে শোভনের গাল বেয়ে চোখের জল মাটিতে পড়ে যায়।
-----::-----
অসিত খাটুয়ার দুটি অণু গল্প
হ্যালো সুভাষবাবু
আসা—৫ই নম্ভেবর,১৯৩৮ যাওয়া—৪ই নম্ভেবর,২০২৩
হ্যালো সুভাষবাবু, চিনতে পারছেন, ‘শ্রেয়সী অনলাইন পত্রিকা’ থেকে বলছি। স্যার কেমন আছেন? ওপার থেকে ভেসে এলো....আমি শাশ্বত আনন্দপূর্ন শান্ত অবস্থায় আছি। কারণ এখানে শঠ ,ভণ্ড, প্রতারক নেই। নেই কোন রাগ, দ্বেষ,হিংসা। ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ-এই চারটি পুরুষার্থের খেলা নেই। শাসন–শোষন নেই, কামনা-বাসন,আসক্তি,ভয় নেই। ব্রাহ্মন-চন্ডাল, ধনী-নির্ধন, জ্ঞানী- অজ্ঞানী, সব মানুষ সমান শক্তির অধিকারী। এখানে কর্মের নীতি-জন্মান্তর নেই। সবাই নিষ্কাম কর্ম করে। এখানে নন্দনকাননের দিকে তাকালে সত্য-শিব-সুন্দরের
উপলব্ধি হয়।
এখানে একজনকে দেখলাম। উনাকে সবাই ব্রহ্ম বলছে। ওরে বাবা ওনার কুয়ালিটি ও কোন্টিটি বলে শেষ করা যাবে না। স্যার বলুন বলুন ফ্রি টকটাইম আছে।তাহলে তোমরা শোন—তিনি অনন্ত জ্ঞানী, সর্বশক্তিমান,অনন্ত ঐশ্বযর্বান, একত্ব, নিত্যপুর্ন, নিত্যমুক্ত। তিনি নির্গুণ, নির্বিশেষ, অবর্ননীয় সত্তা। তিনি সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরূপ। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। তিনি স্ত্রীও নয় পুরুষও নয়, তিনি কুমারও নয় কুমারীও নয়। তিনি সৃজন কর্তা, রক্ষা কর্তা ও সংহার কর্তা ।
রাখছি, আমি জানি, তোমরা সবাই এখানে আসতে পারবে না। কারন তোমরা আমার মতো সত্যদ্রষ্টা কবি, সংগীতপ্রেমী, জ্ঞানপিপাসু নও। তোমরা সৎ ভাবে মানুষের সেবা করছো না। তোমরা আমাকে অনুসরণ কর তবেই এখানে আসতে পারবে। রাখছি, এখানে এলে দেখা হবে,কথা হবে।
স্ট্যাচু
গ্রামের ছোটোবেলার দুই বন্ধু—নরেন সেন ও অজয় রায়। এখন দু’জনেই প্রতিষ্ঠিত। নরেন হাইস্কুলের শিক্ষক, অজয় বিডিও। নরেনের ছেলের নাম বীরেন। অজয়ের ছেলের নাম সুজয়। দুর্গাপুজোর ছুটিতে গ্রামে এসেছিল। দুইজনের মধ্যে পুরোনো দিনের কত গল্প ও কত আড্ডা হল।
নরেনর ছেলে বীরেন পড়াশুনায় খুব ভালো। সে এখন CRP-র প্রধান অফিসার। তার স্ত্রী নন্দিনীও শিক্ষিক।
এদিকে অজয়ের ছেলে সুজয় পড়াশুনায় মোটামুটি। সে কলেজে পড়া কালীন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে য়ায়। এই সময় সব রকমের নেশা আয়ত্ত করে। কলেজে পাঠ শেষ করে দুই বছরের মধ্যে স্থানীয় বাজারের পাশে একটি হোটেল ব্যবসা খোলে। অনতিবিলম্বে সেখানকার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হন। বিয়ে করে এক নেতার মেয়েকে। এরপর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জেলাপরিষদে জয়লাভ করার পর কয়েক বছরের মধ্যে বিধায়ক ও মন্ত্রী হয়ে যায়।
ঘটনাচক্রে মন্ত্রী সুজয়বাবুর বডিগার্ড হিসাবে নিযুক্ত হন বীরেন। সেই সূত্রে মন্ত্রী জনসভাগুলোতে নিরাপত্তার জন্য মঞ্চে উপস্থিত থাকে বীরেন। এমনি এক জনসভায় এক আত্মঘাত জঙ্গী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মঞ্চ উড়িয়ে দেয়। সুজয় ও বীরেন ছাড়াও অনেকেই স্পট ডেড হয়।
মন্ত্রীর বডি পাওয়া গেলেও বীরেনর বডি পাওয়া যায়নি। মন্ত্রীর বডিকে গার্ড- অফ-ওনার দিয়ে সৎকার করা হয়। শহরের মধ্যে তার স্ট্যাচু নির্মিত হয়। এদিকে বীরেনের নাবালক ছেলে একটা ফোটো রেখে শ্রাদ্ধকর্ম সম্পন্ন করে। পরের বছর তার ফটোটি দেখতে পাওয়া গেল না।
এদিকে অশিক্ষিত,মুর্খ সুজয়ের স্ট্যাচুর পাদদেশে কত মানুষ জড়ো হয়, দাবি পূরণের আওয়াজ তোলে। কত নেতা, মন্ত্রী এসে মাল্যদান করে। যুগ যুগ ধরে আমাদের মধ্যে স্মৃতিরক্ষার্থে অশিক্ষিত সুজয় স্ট্যাচুর মধ্যে বেঁচে থাকল। আর শিক্ষিত বীরেনের ফটোটি তার ছেলের ফ্লাটে জায়গা নেই, কোন আস্তাকুঁড়ে পড়ে আছে কে জানে।
--::--