গল্প
দেবাশীষ সরখেলের অণু গল্প
ডিভোর্স
বিরথ চন্দ্র মণ্ডল
হ্যালো ঐন্দ্রিলা !
কদিন ধরে তোকে একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয়নি। কথাটা ঋক বাবুকে নিয়ে। ভেবেছিস কিছু ? তোর মতামতের অপেক্ষায় ছিলাম।
ফোনের ওপার থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে সৃজার বাম কানের চার পাশে ---- ,
--- হাঁ মা । তুমি তো আগেও বলেছিলে ওনার কথা। আমি ওনাকে দেখিনি যদিও । তোমার কাছে যতটুকু শুনেছি ; উনি খুব ভালো মনের । তোমার কোন সিদ্ধান্তে আমার আপত্তি থাকবে না ।কারণ আমি জানি , তুমি ভুল কিছু করবে না।
তা - ছাড়া , তোমার কাছে আমিও আর ক' দিন থাকবো বলোতো ? আমার একাডেমিক এবছর লাস্ট ইয়ার । তারপর রেজাল্ট। তার পর প্লেসমেন্ট । ডিপার্টমেন্ট যেখানে পোষ্টিং দেবে, সেখানেই থাকতে হবে। আর তাছাড়া ......
কথা চলতে থাকে এই ভাবে .....
দীর্ঘ ক্ষন । কখনো চল্লিশ - পঞ্চাশ মিনিট,এক ঘন্টা ছাড়িয়ে যায় কথায় কথায়।
মাত্র কুড়ি পেরিয়েছে মেয়েটি । অথচ সংসারের চাল চিত্তির, সম্পর্কের বাঁধন - ফাটল - তার বাবাকে নিয়ে অশান্তি, বাবার সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া, মায়ের একাকীত্ব - এ সবের সাক্ষী সে নিজেই। তার কথা - বার্তা - ভাব - ভঙ্গিমা , একদম পরিনত মহিলার মতো।
ওদের কথা হচ্ছিলো ঋক'এর সামনেই। ঋক আগেও ওদের দু'জনের কথা শুনেছে। শুনে স্থম্ভীত হয়েছে ।
সৃজার সাথে পরিচয় বছর খানেকের বেশি। এরই মধ্যে বুঝে গেছে , আর পাঁচটা নারীর মতো সে নয় । ওর কোন পি এন পিসি নেই । শুধু কাজ আর কাজ। এক কথায় কাজ পাগল মানুষ । ভীষন দরদী । লাবণ্যময়ী । রূপসী । সুন্দর মুখের গড়ন - কমনীয় তায় সত্যি জাদু আছে বলতে হবে।
ঋক আগের তুলনায় অনেক শান্তিতে আছে।
স্বস্তিতে আছে। একটা সময়ে, সব ছিল তার। কিন্তু , এখন কিচ্ছু নেই। এই দূর্বিসহ জীবন থেকে এতদিন বেরিয়ে আসতে চেয়েও পারেনি । একমাত্র সন্তানের দিকে তাকিয়ে।
সেই সন্তান বড় হয়েছে। চাকরি করছে। তার অনেক দূরে পোষ্টিং।
তার নিজের দিকে তাকালে বড্ড অসহায় লাগে। কী ছিল না তার ! মাথার উপর ছাদ ছিল। সরকারি ভালো চাকরি ছিল । রাজ্যের এক নাম করা দাবাঢ়ু'র সম্মান ছিল । স্বভাবে নম্র ভদ্র ছিল।
তবুও দিনের শেষে ঘরে ফিরলে অশান্তির শেষ ছিল না। তবে ,সৃজার মতো সমঝদার মানুষের অভাব ছিল বুঝতে পারছে ।
ঋক জানে , এ পৃথিবীতে সব কিছু মেনে নেবার মানুষ থাকলেও, মনে নেবার মানুষের বেশ অভাব । কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হয় তাকে ।
আর যাই হোক ; শ্রীজা তাকে ভালোবাসে। একদমই অন্তর থেকে। কোন খাদ নেই সে ভালোবাসার।
শ্রীজা তাকে বিয়ে করতে চায় । নতুন করে সংসারী হতে চায়।
এই প্রসঙ্গে কথায় কথায় ঋক বলেছিল -
-- আর বিয়ে টিয়ে নয় । আমরা লিভ টুগেদারে থাকবো ।
এই কথা শুনে শ্রীজা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার উপর । বলেছিল --
----- না না একদমই নয় !
এটা কী দিল্লি ? নাকি মুম্বাই - নাকি কলকাতা ?
যে , যেভাবে খুশি থাকবে ?
এটা একটা ছোট খাটো টাউন । বলতে পারবো প্রত্যন্ত টাউন। লোকে ছিঃ ছিঃ করবে !
তার হাতের চেটো খানা বুকে আলতো স্পর্শ করে দেখিয়ে বলেছিল ---তুমি আমার এই খানে থাকবে মশাই । একদমই এই খানে।
অফিস যাবার আগে - পরে যখনই সুযোগ পায় , শ্রীজা ফোন করে । ঘরে থাকলে ঋক ফোন ধরে মৌপিয়ার সামনে । ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে যা বলার বলে। কোন ভ্রুক্ষেপ করে না।
মৌপিয়ার সাথে বিয়ের পর , বছর তিনেক বেশ সুখেই ছিল । মৌপিয়া চাকরি পেল। তার পর নানান অছিলায় অশান্তি। অশান্তি বেড়ে চলছিল।
মৌপিয়ার কখনো মন খারাপ দেখেনি ঋক । দেখে তো মনে হয় বিন্দাস আছে। ঋক নিজেই ভালো নেই ।
বার বার , হাজার বার, মৌপিয়ার কাছে সেধে ছুটে গেছে ঋক । হাত ধরেছে। কতবার জিঞ্জাসা করেছে, কী তার দোষ ?
বিনিময়ে শুধু নীরব থেকেছে।
মনের কথা তো দুর ! ফিরেও তাকাইনি মৌপিয়া। চোখে , মুখে , ব্যবহারে বুঝিয়ে দিয়েছে। ঋক তার কেউ নয়।
নিরুত্তর দেখে বার বার চিৎকার করেছে ঋক --তাহলে লোক দেখিয়ে পড়ে থাকা কেন !
ছেড়ে দিলেই তো পারো ! অন্তত দুটো প্রাণ বেঁচে যেতো !
আজ ছুটির দিন। সন্ধ্যের সময় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল মৌ। যখন তখন যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।
কিন্তু ঋক পারে না। অ'সময়ে হাজার চেষ্টায় ও ঘুম আসেনা তার ।
সকালে কথা হয়েছিল সৃজার সাথে। ফোনের রিং টোন বেজে উঠতেই ফোনটা তুলে নিয়ে দেখল, সৃজার ফোন। ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বলে - হ্যাঁ বলছি,বলো ...
------ঋক । বলতে ভুলে গেছিলাম। ডিভোর্স'টা কখন নিচ্ছো বলো ?
ঋক উত্তর দেয় ---- সে হয়ে যাবে'ক্ষন। এ নিয়ে উতলা হয়ো না।
শ্রীজা বিরক্ত হয় । বলে---না, না আমার শিগগির চাই -চাই - চাই। আর একদমই ডিলে করো না ।
কাল পরশুর মধ্যে বলে কয়ে নিয়ে নাও সোনা ! ।ও'কে জানিয়ে দাও ,তুমি মিউচুয়াল চাইছো। এতে কোনো দাবি দাওয়া থাকবে না । বুঝলে....
আমিও বাবলুর সাথে কথা বলে নিয়েছি।
কি শুনলে তো কথাটা ? কোন কথা বলছো না যে ...!
ফোনের সব কথা মৌপিয়া শুনছে হয়তো । বিছানায় বার বার নড়াচড়া হতে দেখেছে। এখনতো ঘুমায়নি। কি কারনে জেগে , কি জানি ? ফোন ধরা অবস্থায় কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না ঋক।
কোনরকম বলল --আচ্ছা ঠিক আছে , দেখছি।
ঋক মৌপিয়া' কে সেদিন বলেছিল --
আমাদের কঙ্কালসার সম্পর্ক । তা টিকিয়ে রেখে কী লাভ ? তার চেয়ে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া ভালো। আমাদের মধ্যে কোন দাবী থাকবে না।
উত্তরে কিছুই বলেনি মৌ।
কাজের মেয়ে আসে। রান্না করে। রাতে এবং সকালে। রাত হল। একা একা বেড়ে খেয়ে নেয় ঋক।
রাতের খাবার সেরে তার রুমে এল।, মৌ তার বিছানা করছে দেখে অবাক হয়ে যায় সে । মৌ'র বিছানা তো ঐ ঘরে ,! তাহলে !
কিছু না বলে চুপচাপ বিছানায় এল।লাইট নিভালো।এসে শুয়ে পড়লো সে ।
ঘুম আর হঠাৎ ধরে না । চোখ বন্ধ অবস্থায় বুঝতে পারছে । কেউ তার বিছানায় ডুকছে । কে আবার ? বুঝতে বাকি রইলো না তার। বিছানায় এসে ঠায় বসে রইল মৌ। ঋক এসবের কোন পাত্তা না দিয়ে চোখ বন্ধ করল। ভোরে
যথাসময়ে উঠতে হবে তাকে।
কত সময় কাটল বুঝতে পারেনি ? সময়টা হয়তো আধা ঘন্টা ,এক ঘন্টা হবে ! নাইট বাল্ব এর টিমটিমে আলোয় দিব্যি বুঝতে পারছে, মৌপিয়া' র চোখ থেকে ঠষ্ ঠষ্ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর আঁচল দিয়ে নাক , চোখ বার বার মুছে নিচ্ছে ।
উঠে বসলো ঋক ।
বলল -- কি হয়েছে গো মৌ?
এতক্ষণে নিজের আবেগকে অতি বল পূর্বক এক রকম জোর করে আটকে রেখেছিল মৌ। ঋক'এর এমন দরদী কথায় আর আটকে রাখতে পারল না। মুহূর্তেই হাউ হাউ করে কেঁদে ঋক'এর গলা জড়িয়ে ফেলল ।
কাঁদতে কাঁদতে বলল --আমি তো খুব খারাপ মেয়ে। তোমার চোখে একদম বাজে মেয়ে। ডিভোর্স চেয়েছিলে তো।
কাল চলো ,দিয়ে দেবো।
ঋক কোন রকম সম্বিত ফিরিয়ে নিয়ে বলল -- ডিভোর্স দেওয়ার কথাটা তুমি কী মন থেকে বললে ? নাকি আমি চেয়েছিলাম বলেই দিতে চাচ্ছো ?
ঋক'কে আলিঙ্গনে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মৌপিয়া। অভিমানী সুরে বলল ---তুমি বুঝতে পারছ না কি বলতে চাইছি ? সে বোঝার মানুষ কী তুমি ?
আর কোন কথা বলতে পারেনা মৌপিয়া । ডুকরিয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিল